সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানের সংগে আমাদের দেশের মানুষের জীবনের বাস্তব যোগাযোগটা কোথায়? যদি বাস্তব যোগাযোগ নাই-ই থাকে তা হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসকল বিষয় পড়ানো এবং সেজন্য বিদেশে লোক পাঠিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার সার্থকতাটা কোথায়? জ্ঞানকে যদি জীবনে প্রয়োগ করা গেলো না, সে জ্ঞানের চর্চা করে কি লাভ? সমাজ কেননা সাদা হাতির মতো এই পতিদের পুষবে, কেনো দুধ-ঘি খাইয়ে তাদের মোটা তাজা করবে? পণ্ডিতেরা পণ্ডিতদের জায়গায় অনড় স্থির থাকবেন । আমাদের দেশের পরম উপকারী জন্তুটির মতো মনের সুখে জাবর কাটবেন এবং নতুন প্রভু পেলেই প্রভু বদলের আনন্দে চীৎকার করে উঠবেন । আর সমাজের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে এ তো হতে পারে না। এক সময়ে সমাজের চক্ষুষ্মন মানুষদের এই পণ্ডিতদের প্রতি তাকাতে হয়, নইলে সমূহ ধ্বংস অনিবার্য । জ্ঞান মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। পণ্ডিতদের প্রভাবে আমাদের সমাজে নানান বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছে কিনা সেটিই দেখতে হবে। সমাজে পণ্ডিতের প্রয়োজন নেই একথা সত্যি হতে পারে না। তবে এমন পণ্ডিত প্রয়োজন যাদের প্রভাবে গোটা দেশের চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠবে, বহুকালের স্থবির জীবন ভেতর থেকে নড়ে উঠবে। তাদের শিক্ষাপদ্ধতি মানুষে মানুষে ভেদাভেদের প্রাচীরে শানানো আঘাত করবে, মানবিক বৃত্তিগুলোর উৎকর্ষ সাধন করবে, সুন্দরের বোধকে জাগ্রত, প্রাণবন্ত করে তুলবে, জড়কে পোষ মানাতে শেখাবে। শুধুমাত্র ভাষা এবং সাহিত্যকে আশ্রয় করে এসব হওয়া সম্ভব নয়। জীবনের অন্যান্য বিষয় এবং অন্যান্য মানব বিদ্যার উৎকর্ষ সাধিত না হলে সাহিত্যের উন্নতি হবে এমন আশা করা সুদুরপরাহত। সাহিত্য তো সমাজবদ্ধ জীবনের নানা চিকন মোটা প্রকাশ, আমরা আশা করবো কোত্থেকে?
আমাদের সামাজিক এই যুবদ্ধ স্থবিরতাকে নানান দিক থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহায্যে আলোকিত আঘাত করতে হবে। সে পথেই আমাদের সমাজে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব সূচিত হবে। উন্নততরো সাংস্কৃতিক বিপ্লব উন্নততরো রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্ম দেবে। সুন্দর সমাজই রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রাণ কথা। একটা পর্যায়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক কর্মীদের সাংস্কৃতিক কর্মীর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের রাজনীতি সচেতন হতে হবে। সমাজকে সুন্দর করা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির যৌথ দায়িত্ব।
.
‘বিদ্রোহহীন জীবন বাঙ্গালীর আত্ম অস্তিত্বের অস্বীকৃতি।‘ বাঙ্গালী বারে বারে বিদ্রোহ করেছে কিন্তু লিখিত ইতিহাসের কোনও পর্বে বিদ্রোহকে জাতিগত খাতে প্রবাহিত করে দীর্ঘদিনের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম যেমন দিতে পারেনি বাঙালী, তেমনি পুরোপুরি বিদেশী, বিজাতির অধীনতার বন্ধনও মেনে নিতে পারেনি। প্রতিটি বিদেশাগত চিত্তস্রোতের সঙ্গে সংঘাতে বাঙালী জনগণের মজ্জাগত শৌর্য ফণা মেলেছে এবং সৃজনশীলতা উল্লস্ফিত হয়ে উঠেছে। বাঙ্গালীর প্রথম প্রামাণ্য ছন্দোবন্ধ বাণী বৈদিক নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় বদ্ধমতের বিরুদ্ধে সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের নতুন জীবনবোধের প্রেরণাময় ধ্বনি। তেমনি সামাজিক বিদ্রোহ মুখিয়ে তুলেছে বৈষ্ণব গীতিকার প্রেমময় আর্তি। ময়মনসিংহ গীতিকা, মঙ্গল কাব্য সর্বত্র বিদ্রোহ এক সমাজ আদর্শের বদলে আরেক সমাজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ তাবৎ বাঙ্গালীর শিল্প সৃজনলোকে রক্তবাহী শিরার মতো প্রসারিত।
আধুনিক বাঙলা সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তাতো পুরোপুরি প্রতিবাদেরই সংস্কৃতি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর ডিরোজিও, মাইকেল, দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলে প্রচলিত সমাজ ধর্ম এবং লোকাঁচারের বিরোধিতা করেছেন একদিকে, অন্যদিকে কেউ স্পষ্টভাবে, কেউ আভাষে-ইঙ্গিতে আরেকটি মহত্তরো, সুন্দরতরো সমাজের ছবি শিল্পরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙলার গৌরবময় সাহিত্য স্রষ্টাদের সৃষ্টি থেকে যদি সামাজিক বিদ্রোহ, নতুন মানবিক মূল্যমান প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে কি বাঙলাভাষা বিশ্বের সমৃদ্ধ ভাববাহী ভাষাপুঞ্জের আসন থেকে রাতরাতি প্রাদেশিক ভাষা হয়ে দাঁড়ায় না? রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক মতবাদ ছাড়া তাঁর সাহিত্যের কতোটুকু মূল্য? বিদ্যাসাগরের সৃষ্টিকর্ম থেকে তার বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ঘেঁকে আলাদা করে যদি ফেলা হয়, তাহলে তো তিনি টোলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়ে দাঁড়ান। রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিপ্লব বাদ দিলে অমন সূর্য সঙ্কাশ প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের গর্ব বাঙ্গালী কিভাবে করতো? ভারতের জাতীয় আন্দালনের জান দেয়া নেয়ার মহৎ খেলা এবং রুশ বিপ্লবের অভিনব জঙ্গী মানবতার ডাকাতিয়া বাঁশীর ডাকেই তো কাজী নজরুলের কণ্ঠ নিনাদিত হয়েছে। তার
কবিতায় যে তীব্র আবেগ বিচ্ছুরিত হয়েছে, যে কুল ছাপানো ভালোবাসা লহরিত হয়েছে। তা কি প্রচলিত সমাজকে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে বানানোর, নতুন মানব সম্বন্ধ রচনার ঐকান্তিক হাদ্য প্রয়াস নয়?
বাঙলা সাহিত্য প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, বিদ্রোহের সাহিত্য। কিন্তু সে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিদ্রোহ পূর্ণাঙ্গ নয়। সে দোষ বাঙালী সমাজের। বাঙালী সমাজে বাঙলার মহত্তর মানবদের চিন্তাভাবনা মাত্র আংশিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইংরেজ রাজত্বের কারণেই এমনটি হয়েছে। বাঙালী মুসলমান সমাজে পার্শ্ববর্তী ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের মতো তেমন মনীষী পুরুষের জন্ম হয়নি, যিনি চিন্তাভাবনার বলে আপন সম্প্রদায়ের মানুষকে অগ্রগামী করতে পেরেছেন। মনীষী না জন্মাবার সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার আলোচনার স্থান এ নয় । সে যা হোক, আধুনিক চিন্তাসমৃদ্ধ বিরাট কোনো পুরুষের অভিভাবকত্বের অভাবে বাঙালী সমাজের ভেতর থেকে ধর্মীয় ডগমা বা বদ্ধমত এবং সামাজিক আচারের জঞ্জাল ভেদ করে কোনো বিরাট মানুষ প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে মাথা তুলতে পারেনি। তার ফল দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সামাজিক সংস্কারের কোলঘেঁষা অন্ধকার সামাজিকভাবে কাটিয়ে ওঠা এখনো সম্ভবপর হয়নি। এখনো সকলে ধর্মীয় ভাব অনুভাব এবং অনুশাসনকে অন্ধভাবে মেনে চলেন অথবা যারা একটু উন্নাসিক, নিজেদেরকে সমাজের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন বলে ভাবতে শিখেন। নিজেকে আলাদা ভাবলে কি সত্যি সত্যি আলাদা হওয়া যায়? কোন মানুষ আপন ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে, কোন মানুষ আপন সমাজের ওপর নির্ভরহীন হয়ে বাঁচতে পারে? মানুষ সব সময়ে সামাজিক জীব, তার যা কিছু উন্নতি, অগ্রগতি, সুখ-সমৃদ্ধি সব সমাজেই সম্ভব। কিন্তু বাঙালী মুসলমান সমাজের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেক দিন সে বোধ আসেনি। যে সকল কবি-সাহিত্যিক অল্পবিস্তর সামাজিক ভাবনায় ভাবিত হয়েছিলেন, তারা সমাজকে তেরশ বছর পিছিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। ভূতের পা পেছন দিকে, তাই তাদের দ্বারা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের কোনোও লাভ হয়নি। ধর্মের আওতাভূক্ত, বিধি, আচার, সংস্কার বিশ্বাস, রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন এসব অস্বাস্থ্যকর জেনেও কোনো লেখক শৈল্পিকভাবে বা বিজ্ঞোচিত অথবা মানববাচিতভাবে এ সবকে চ্যালেঞ্জ করেননি। যেখানে পুরোনো বিশ্বাস, পুরোনো মূল্যবোধের প্রতি সজ্ঞান মেধাবী চ্যালেঞ্জ নেই, সেখানে মহত্তররা সৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? যে যুথবন্ধ প্রথায় প্রশস্তি রচনা করে, সে তো দাসত্ব করে, তার অন্তরাত্মা পরাধীন। এই পরাধীন অন্তর থেকে কেমন করে স্বাধীন চিন্তা যা মহত্তরো সৃষ্টির শোণিত, উচ্ছিত হবে? আবার সমাজকে পিঠ দিয়ে একা আনমনে নিজের ভাবনা চিন্তা নাড়াচাড়া করার মধ্যেও ব্যক্তির সাধনার পূর্ণতার অভিলাষ কোথায়? পূর্ণতার সাধনা যেখানে নেই, সেখানে ব্যক্তির একান্ত অন্তরঙ্গ, আবেগ কিভাবে খেলা করে? এখনো পর্যন্ত কোনো বাঙালী মুসলমান লেখক তার সমাজের প্রাণহীন আচার পদ্ধতি, মূঢ়তা, স্কুল বিশ্বাস এসবকে চ্যালেঞ্জ করেননি। রাজনৈতিক উপন্যাস কেউ কেউ লিখেছেন, লিখতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত অর্থে রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তাতো এক ধরণের ক্ষমতালোভী মানুষের ক্ষমতা দখলের ফন্দী মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। রাজনীতি মানব সমাজের সর্বাঙ্গীন পরিণতি নির্ধারণের নিয়তি, যারা রাজনীতি করেন তারা বিশ্বাস করলেও লেখকেরা, কবিরা, সাহিত্যিকেরা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির কোন মানসিক মেলবন্ধন সাধনা করতে পারেননি বললেই চলে। অথচ মোস্ত ফা কামাল পাশার তুর্কীতে এই রাজনীতিই ধর্মীয় জাড্য, সামাজিক কূ-রীতি খেদিয়ে তাড়িয়েছে। সে-তো অনেকদিন আগের কথা। তুর্কীতে অনেকদিন আগে যা হয়েছে আমাদের দেশে এখন হওয়া সম্ভব নয় কেনো? এই প্রতিবাদের অভাবে আমাদের সমাজের জ্ঞানী গুণী মানুষকেও অন্ধ তামসিকতাসম্পন্ন মানুষদের দাস হয়ে থাকতে হয়। যে দু’একজন মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করেন তারা বাঁচাল। তাদের সঙ্গে সে শল্য চিকিৎসকের তুলনা করা যায়, যে রোগ দূর করার বদলে রোগী মারে। মনুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এবং মানুষের প্রতি মমতাহীন কবি, সাহিত্যিক কিংবা সমাজসংস্কারক কারো কোনো দাম নেই।