.
তেইশ চব্বিশ বছর বড়ো কম সময় নয়। এই সিকি শতাব্দী পরিমাণ সময়ের মধ্যে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিটি স্থাপিত হওয়া উচিত ছিলো। বাঙলাদেশের সাহিত্যে দু’তিনটি কবিতার বই, দু’তিনটি উপন্যাস, দু’তিনটি প্রবন্ধের সংকলন, দুটি কি তিনটি উল্লেখ করবার মতো নাটক বা অ-নাটক এই-ই তো আমাদের মোটামোটি মানস ফসল। এই সাহিত্য নিয়ে বিশ্বের দরবারে হাজির হওয়া দূরে থাকুক, সামগ্রিক বাঙলা সাহিত্যের উৎকর্ষের নিরিখে এ আর এমন কি! কালজয়ী এবং দেশজয়ী হওয়ার স্পর্ধা রাখে এমন কোনো সাহিত্য এদেশে রচিত হয়নি। তবু বাঙলা ভাষাভাষী জগতে বাঙলাদেশের সাহিত্যের যে একটি বিশেষ স্থান আছে আমরা মনে করছি, তার কারণ আমরা অত্যধিক অযৌক্তিক আশাবাদী এবং বিচার বোধ বর্জিত। লাভ ক্ষতি খতিয়ে দেখার ক্ষমতা আমাদের খুবই সামান্য। কেউ যখন আমাদের পিঠ চাপড়ায়, তখন মহানন্দে আমাদের দেশের গর্জনকারী চতুস্পদ জন্তুটির মতো লেজ নাড়তে থাকি। অপরের স্তোকবাক্যে মোহিত হয়ে দন্ত ব্যাদান করে এরকম ভাবখানা করি যেনো সত্যি সত্যি বাঙলাদেশের নির্মাণ বুদ্ধি, স্বপ্ন, কল্পনা সংঘাত সব আমাদের জীবনে ধারণা করেছি। আদতে এসব কি সত্যি? যে কোনও দেশের চব্বিশ বছরের সাংস্কৃতিক প্রয়াসের সাথে আমাদের তুলনা করে দেখতে পারি। এই চব্বিশ বছরে ক’টি বিজ্ঞানের মৌলিক আবিষ্কার এদেশে হয়েছে! পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা এবং শরীরবিদ্যা, প্রযুক্তি এবং গবেষণার দিক দিয়ে কতোদূর উৎকর্ষ অর্জন করেছে? কখানি গবেষণাসমৃদ্ধ ইতিহাস লেখা হয়েছে! সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি এসব বিষয়ে আমাদের মাটি, এবং সমাজ সম্পদ নিয়ে কোনো বই মাতৃভাষা বাঙলায় নয় ইংরেজীতেও প্রকাশ পেয়েছে কি? বিশটি বিষয় মিলিয়েও একগণ্ডার অধিক আমাদের পণ্ডিতদের লেখা ভালো বই এ দেশে কিংবা বিদেশে প্রকাশিত হয়নি। অথচ এসব বিষয়ে সুদক্ষ পণ্ডিত বানাবার জন্য বছরে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ফি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকে ফি মাসেই পণ্ডিতেরা কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলগুলোতেও বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তার নগদ ফল হয়েছে এই যে, বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের দৌরাত্মে সমাজে টেকা একরকম দায় হয়ে পড়েছে। এই বিলেত, আমেরিকা ফেরত পণ্ডিতেরা বিলেত, আমেরিকার কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন। স্বদেশের মাটির দিকে তাদের দৃষ্টি কদাচিৎ আকৃষ্ট হয়। সলিড কিছু করার বদলে বিলেতী বিদ্যের গুমর দেখাতেই তারা অত্যন্ত আনন্দ পেয়ে থাকেন। বিলেতে যেয়ে আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন এমন দু’তিনখানা বই নেড়েচেড়ে দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। দেখে শুনে ধারণা জন্মে গেছে যে ও ধরণের বই ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরীর ভিরের মধ্যে বসে চা সিগ্রেট খেয়ে আড্ডা গুলতানি মেরে তিন কি সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যে অনায়াসে লিখে দেয়া যায় । কিন্তু এসকল মহাগ্রন্থ রচনা করতে আমাদের পণ্ডিতেরা বিলেত যেয়ে তিন তিন বছর কাটিয়েছেন এবং দেশে ফিরে আর তিন তিন বছর বিলেতের গল্প করে কাটাচ্ছেন। কি অপূর্ব বিদ্যা, বিলেতী ডিগ্রীর কি চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওদের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে আমরা মনে করছি, পড়াশুনা ইত্যাদির কাজ ভালোভাবেই চলছে। প্রকৃত ভালোটা তখনই চোখে পড়ে, যখন গোটা দেশের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ, অপকর্ষের দিকে তাকাই। দেশ দেশের হিসেবে চলে, সমাজের দারিদ্র্য বেড়েছে, সমাজের অজ্ঞতা দিনে দিনে পাষাণের মতো কঠিন আকার ধারণ করছে। সবল দুর্বলকে অত্যাচার করছে। আর আমাদের পণ্ডিত মহাশয়েরা পরস্পরের পিঠ চুলকে, খুনসুটি দিয়ে দিব্যি আরামে দিন কাটাচ্ছেন। আর শাসক পরিবর্তনের সময়ে নিজেরা সদল বলে জয়ধ্বনি দিয়ে বলেন, আমরাও আছি তোমার সাথে। এই সাথে থাকার কাজটি তখন থেকেই শুরু হয়, যখন সিংসনে চড়ার সময় আসে। আমাদের দেশের পণ্ডিতদের এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকার প্রতি ঘৃণা করাটাও অনেক সময় মনে হয় পণ্ডশ্রম। জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য বিষয়গুলোর চর্চা যেহেতু এখনো আদিম পর্যায়ে রয়ে গেছে, তাই সংস্কৃতি বলতে সাধারণ্যে একটি ধারণা জন্মে গেছে। তারা সংস্কৃতি বলতে মনে করতে আরম্ভ করেছেন ক’টি কবিতা, কটি গল্প, উপন্যাস, ভাওয়াইয়া গান, নজরুল গীতি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত । জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলোর কোনো স্থান যেনো আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমাদের দেশে তাই সংস্কৃতিবান বলতে সেই শ্ৰেণীটিকেই বোঝায়, যারা শুধু কবিতা লিখার আজীবন ব্যর্থ প্রয়াস করেন, গল্প লিখতে যেয়ে মার খান, বাজে উপন্যাস লিখেন। এসবের সঙ্গে আরো দুটো গুণ থাকা চাই। প্রভুভক্তি এবং মার্জিতি। পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের বদল হয় প্রাকৃতিক নিয়মে আর আমাদের দেশের পণ্ডিতদের প্রভু বদল হয় ক্ষমতার নিয়মে।
বিদ্যা, বুদ্ধি এবং জ্ঞানের ভূমিকা কি সে বিষয়ে নিবিড়ভাবে চিন্তাভাবনা করেন, এরকম আধা ডজন মানুষও আমাদের দেশে নেই। এই না থাকাটা যে কাতোটুকু না থাকা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা যায়। যদি আধা ডজন তেমন মানুষও থাকতেন বাঙলাদেশে সুস্থভাবে জ্ঞান এবং বিদ্যা চর্চার একটা আবেষ্টনী রচনা এতোদিনে হয়ে যেতো। সুস্থ জ্ঞানচর্চার একটা ক্ষেত্র যদি তৈরি হতো, তাহলে বর্বরেরা পদ্মার চর দখল করার মতো লাঠি বাগিয়ে হৈ হৈ করে ছুটে আসতে পারতো না। এতোদিনেও জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভাবকল্পনার ক্ষেত্রে আমরা এমন অসহায়, এমন কাঙ্গাল থেকে যেতাম না । আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃত লক্ষ্য কি সে সম্পর্কে বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই শেষ পর্যন্ত অনবহিত থেকে যান । বাঙলাদেশের সেরা বিজ্ঞানী বলে কথিত মানুষটি যখন শুধুই অর্থের জন্য নিম্নশ্রেণীর দীনিয়াত বই লেখেন, দেখেশুনে হতবাক না হয়ে উপায় থাকে না। শ্রেষ্ঠ লোকটিই যখন এরকম, কম শ্রেষ্ঠরা কি রকম খুব সহজে বুঝে নেয়া যায়। যে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বলে মানুষের জীবন সুন্দর, স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে, সমাজ উন্নত হচ্ছে তেমনি বিজ্ঞান চর্চা আমাদের দেশে কই? আমাদের দেশে আবিষ্কার কই? আর বিজ্ঞানীও বা কোথায়? বস্তুত এই দেশে ধর্মান্ধ মোল্লা এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে খুব তফাৎ নেই।