এখন সকলেই উপলব্ধি করেছেন, উনিশশো সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ একটা প্রকাণ্ড রাজনৈতিক ভ্রান্তি। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বা তার পূর্বের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের দ্বিজাতিতত্ত্ব আসলে মন গড়া জিনিশ। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। তবু বাঙলার মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিলো তার একটি সাক্ষাৎ কারণ তো নিশ্চয়ই ছিলো। বাঙলার মুসলমানেরা হিন্দু ভূস্বামী এবং বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনুকম্পার পাত্রে পরিণত হবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তাই বাঙলার মুসলিম সম্প্রদায় পশ্চিমা সন্তানদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে পাকিস্তান দাবী তুলেছিলেন। চব্বিশ বছর পর দেখা গেলো, যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের দাবীতে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেই জিনিশটিই আগাগোড়া ভিত্তিহীন। বাঙলাদেশের জনগণের মন মানস যে উপাদানে গঠিত হয়েছে তা হিন্দুর হোক, মুসলমানের হোক, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী যে সম্প্রদায়েরই হোক না কোনা তাই-ই আমাদের বাঙলার সংস্কৃতি। বাঙলাদেশে সংস্কৃতির এই রূপরেখাঁটি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরেই আভাসিত হয়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতিতে বিভাগপূর্ব আমলের বাঙালী সংস্কৃতি বলতে যা কিছু বোঝাতো তার অনেক কিছু থাকলেও এ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিশ। বিপ্লবের অর্থ তো ধ্বংস নয়, পুনর্গঠন। বাঙলাদেশের সংস্কৃতিতে বাঙলার মনীষীবৃন্দের চিন্তা চেতনার স্থান নিশ্চয়ই আছে। সে সঙ্গে গ্রাম বাঙলার মানুষের সুখ-দুঃখ যা এক সময়ে প্রায় অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান কবিয়ালের মুখে ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকার আকারে নিঃসৃত হয়েছে, মনসামঙ্গল ইত্যাদি কাব্যে আকারিত হয়েছে, প্রাণের আকুতি-বেদনা-আকাঙ্খ ভাটিয়ালী, জারী সারী; এ সকল গানে ফেটে পরেছে–তাও আছে। কোনো রাজ শক্তির বা রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলে তা তুচ্ছ বা ফেলনা নয়। আমাদের জীবন থেকে এসব উঠে এসেছে বলেই এখনো তাজা, সজীব এবং হৃদস্পন্দনে ভরপুর। জনগণের এই আবেগের ঘরে আমাদের নাড়া দিতে হবে এবং জীবনের এই আগুনকেই যুগের সমস্যা, সংগ্রামের খড়কুটোতে সহস্র শিখায় জ্বালিয়ে তুলতে হবে। এই কাজটি যতো সুচারুরূপে এবং যতো কম সময়ে করা যায় ততোই পূর্ণাঙ্গ এবং একটি সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি শীগগির সৃজিত হবে।
এখন কথা দাঁড়াচ্ছে, বাঙলাদেশে কি সমাজতন্ত্র সত্যি এসে গেছে? কানাঘুষো চলছে বটে কিন্তু সমাজতন্ত্র আসেনি। আসবে কি? হাঁ; আসতে পারে, যদি জনগণ দাবী করে। আমাদের দেশের জনগণ একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের আত্মনির্ভরতা এবং সংঘ শক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় একথাটি বুঝে ফেলেছেন। তাদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতনতাও অনেকগুণে বেড়েছে। তারা জানেন, তারা সম্মিলিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে জীবনকে অনেকদূর সুখী এবং সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। এই শক্তিসচেতন জনগণকে বিপথে পরিচালিত করাও খুব সহজ। সামাজিক দাবী উপেক্ষা করে ব্যক্তি, গোষ্ঠীদল আপনাপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতে পারে। পথে ঘাটে প্রায়ই মানুষকে বলতে শোনা যায়, অমুক ছাত্রনেতার অতো খানি বাড়ি, অমুক নেতার অতো টাকা ইত্যাদি। এটা এখন একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নেতা, উপনেতা এমন কি যুব নেতাও নয় তারাও উচ্চাকাক্ষী হয়ে পড়েছে। তাদেরও গাড়ি চাই, বাড়ি চাই। কেউ দেবে না, আইন সাহায্য করবে না, কিন্তু তারা লুঠ করবে, হাইজ্যাক করবে, জোরে দখল করবে। তাদের মোক্ষম যুক্তি দেশের উন্নতির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অংশ গ্রহণ করেছে। দেশের উন্নতি যদি না হয় ভাগ্যবানদের অনুসরণে নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধনের অধিকার তাদের নিশ্চয়ই রয়েছে। বিশেষত হাতে যখন অস্ত্রপাতি আছে, পরোয়াটা কিসের। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এই অবস্থার উপশম যদি না করা যায়, তাহলে সমাজতন্ত্র আসবে না এবং সাধারণ মানুষও কোনো দিন তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে না ।
সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও এই ধরণের নৈরাজ্যের হাওয়ার অনুপ্রবেশ ঘটছে। যোগ্যতা থাক না থাক, কাজ কিছু হোক না হোক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও আশাতীতভাবে উচ্চাকাক্ষী হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর যেমন কলেজের আরবী ফারসী অধিকাংশ শিক্ষক রাতারাতি অধ্যক্ষ বনে গিয়েছিলেন, এখনও সেরকম কিছু লোক প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হচ্ছেন। তাদের একমাত্র যোগ্যতা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁদের গড়মিল নেই এবং তারা বাঙালী অর্থাৎ কলাবরেটর বলে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নেই। একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি বিভাগে কোনো একজন শিক্ষক প্রফেসর মনোনীত না হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে তার সমর্থক অনুগত ছাত্ররা নির্বাচক মণ্ডলীর বাড়ি গিয়ে হামলা করেছেন বলে কাগজে সংবাদ পড়েছি। একজন ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে কতোদূর অযোগ্য হলে, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করতে পারেন, তা অনুমান করা মোটেই দুষ্কর নয়। শিক্ষকেরা নিজেদের পদবৃদ্ধির জন্য যদি এতোদূর উৎসাহিত হয়ে পড়েন এবং ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকেন, দেখা যাবে প্রত্যেক শিক্ষকের কিছু কিছু সমর্থক ছাত্র রয়েছে এবং শিক্ষকেরাও ছাত্রদের দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তুলবেন। শিক্ষকেরা যদি এই করে সময় এবং শক্তি ব্যয় করেন, নতুন সংস্কৃতি এবং শিক্ষানীতি যা বর্তমান বাঙলাদেশের অপরিহার্য সামাজিক দাবী তার কি হবে? দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকেরাও শিক্ষক এই পদ বৃদ্ধির খেলায় অবতীর্ণ হবেন এবং তা কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাই যদি না হয়, সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা সংস্কৃতি তো হাওয়া ফুড়ে জন্মাতে পারে না।