.
বাঙলাদেশে এখন একটি রেনেসাঁর সময়। কিন্তু নানামুখী ঘটনা এবং সামাজিক শক্তিগুলোর ঘাত প্রতিঘাতে একটি জাতির শিল্প সংস্কৃতিতে নতুনতরো অধ্যায় সংযোজন এবং বিজ্ঞানে দীক্ষা গ্রহণ নানা কারণে বিলম্বিত হতে পারে। কেননা পাকা বীজও পাথরে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তবু একটি রেনেসাঁ যে আসন্ন এ দেশে তার সম্ভাবনাগুলো কি কি সংক্ষেপে আলোচনা করা মোটেই অসম্ভব নয়। একটি সমাজ যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, তার প্রতিষ্ঠিত বিচার-আচার, সংস্কার, বিশ্বাস, রীতিনীতি, আইনকানুন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তব জীবনের চাহিদা মেটাতে মোটেই সক্ষম হচ্ছে না, তখন সেই বিশেষ সমাজের বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনকে সমৃদ্ধ এবং গরীয়ান করার প্রেরণায় সম্পূর্ণ নতুনভাবে, নয়া দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিচার করতে হয়। নতুন চিন্তার অস্ত্রে সজ্জিত নতুন মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। তারা। পুরোনো সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে চুরে নতুন যুগের প্রয়োজন মতো নতুনভাবে ঢালাই করে। তখন সমাজে মানুষের সম্পর্কের ধরণটা একেবারেই বদলে যায়।
মধ্যযুগের ইউরোপে এমনটি ঘটেছে। কতিপয় মানুষ যখন উপলব্ধি করলেন, যাজকেরা যা বলেন অর্থাৎ রাজা আল্লাহ্র ছায়া, নারী নরকের দ্বার, মানুষের রক্তমাংসের দাবী শয়তানের প্ররোচনা, মনের প্রশ্নশীলতা নয়, বাইবেলের বাণীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যই সৎ জীবন যাপনের প্রকৃষ্ট উপায়; এ সবের পেছনে কোনো বাস্তব সত্যের সমর্থন নেই, তখন থেকে তাঁরা মানব জীবনকে জাগতিক সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে চিন্তা করলেন, ছবি আঁকলেন, রাজনৈতিক সন্দর্ভ রচনা করলেন, কবিতা লিখলেন। দ্য ভিঞ্চির ছবি, শেক্সপীয়রের কাব্য, বেকনের দর্শন, হবস, লক প্রমুখের রাজনৈতিক সন্দর্ভ মূলতঃ অর্গলবদ্ধ মানব চিন্তা চেতনার নানামুখী বহিঃপ্রকাশ। ইউরোপীয় মানসের এই বন্ধনমুক্তি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ফলিত রূপ মহান ফরাসী বিপ্লব। ফরাসী বিপ্লবের ফলে রাজা বিতাড়িত হলো, মানুষে মানুষে সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব অন্ততঃ তত্ত্বগতভাবে হলেও স্বীকৃত হলো। ইউরোপীয় চিত্তের নবতররা সৃজনশীলতা বস্তুবীক্ষা এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরো একটি বিপ্লবের সূচনা করে। সেটি ইংল্যান্ত্রে শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে প্রাচীন পৃথিবীর চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেলো। শিল্প বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব এবং পরবর্তীকালের রুশ বিপ্লব ইউরোপীয় রেনেসার প্রত্যক্ষ এবং দূরবর্তী ফসল।
বলা হয়ে থাকে উনবিংশ শতাব্দীর তৎকালীন বাঙলাদেশেও একটা রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছিলো। প্রতিটি রেনেসাঁর একটি সামাজিক পশ্চাদভূমি থাকে। সমাজের একটি শ্রেণী আপনা থেকে উদ্যোগী হয়েই রেনেসাঁর বীজ ধারণ করে, বহন করে এবং লালন করে। সে শ্ৰেণীটি মানব চেতনার নতুন দিক নির্দেশ করতে প্রয়াসী হয়, এ কারণে যে, তার মধ্যে দিয়েই সে বিশেষ শ্রেণীটির জাগতিক আকাক্ষা স্ফুর্তি লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীর তৎকালীন বাঙলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের ফলে লাভবান হয়েছিলো যে শ্ৰেণীটি, তার বিত্ত, বৈভব এবং সামাজিক মান মর্যাদা সবই বিদেশী রাজত্বের কারণে এবং এই শ্ৰেণীটিই ইউরোপীয় রেনেসাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে। তারাই নতুন মানব ধর্ম প্রচার করলো। নতুন সাহিত্য রচনায় ব্রতী হলো এবং নতুন ভাবে সমাজকে ঢালাই করতে উদ্যোগী হলো। তাঁদের প্রচেষ্টা পুরোপুরি ফলবতী হয়নি। কারণ, বৃটিশ সাম্রাজ্যের লৌহ কাঠামো মেনে নিয়েই তাদেরকে চিন্তা করতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে। শিল্প সাহিত্যে তাঁদের অনেকেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন একথা সত্যি। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের প্রচারিত মতবাদ খুব বেশী প্রসার লাভ করেছে একথা জোর করে বলার উপায় নেই। ইউরোপের ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার আদর্শ সমাজের উঁচুবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে ক্বচিৎ কখনো নীচুতলা স্পর্শ করতে পেরেছে। তাই দেখা যাবে, উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁর প্রভাবে বাঙলাদেশে কতিপয় বিশ্ববিশ্রুত মনীষার জন্ম হলেও তারা সমাজের সাধারণ মানুষকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পেরেছেন। সেকালে সাম্রাজ্যরক্ষার খুঁটি হিসেবে যে শ্ৰেণীটি সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, যারা রক্ত মাংসে নেটিভ এবং মর্জি মেজাজে বৃটিশ, সেই ইংরেজী শিক্ষিত শ্রেণীর স্তর অতিক্রম করে সমাজের প্রাকৃতজনের কাজে উনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দের কোনো প্রভাব পড়েনি। হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ, খৃষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের মনে তাদের ভাবধারা সমানভাবে প্রেরণা জাগানোর কথা দূরে থাকুক, শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের সমানুষকেও জ্ঞানের ভোজে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আহবান করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাই উনবিংশ শতাব্দীর যে রেনেসাঁ তার মৌলিক উপাদান পুরোপুরি ধর্ম বহির্ভূত হলেও তার চেহারাটি ধর্মীয় এবং আকারটি সাম্প্রদায়িক। সুতরাং বাঙলার উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁকে বাঙালী বর্ণ হিন্দুদের নব জাগরণ বলা নানাদিক দিয়েই যুক্তিসঙ্গত। রামমোহন রায়ের শিষ্যদের মধ্যে কেউ নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলেন সত্যিসত্যি, সে রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজ সংস্কার প্রয়াস তার আপন গরি মধ্যেই সীমিত ছিলো। শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য-বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে এ পর্যন্ত বর্ণ হিন্দুদের বাদ দিয়ে নীচুস্তর থেকে কোনো উল্লেখ্য ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীর এমনকি বিংশ শতাব্দীর শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক বৈজ্ঞানিকদের জগত জোড়া খ্যাতি প্রতিপত্তি যেনো সমুদ্র তরঙ্গের শীর্ষে ফরফরাসের মতো। নীচের দিকে আলোকিত করার কোন ক্ষমতা নেই। রেনেসাঁর ভাব তরঙ্গের বেগ বহুকাল আগেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু অতীতের মোহ এখনো বাঙলার ও অংশের মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অতীত এবং বর্তমানের দ্বন্দ্বে অতীত যদি মহীয়ান হয় এবং বর্তমান যদি হয় সমস্যা সঙ্কুল, সহজ বিশ্বাসী মানুষেরা অতীতের ধ্যানেই দিন অতিবাহিত করে। বৃটিশ যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজ প্রয়োজনে সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে, তাদের চিন্তন পদ্ধতি, অভ্যাস, মনন ইত্যাদির ছাপ এখনও বাঙলার মানুষের মনে রয়ে গেছে, একটুও রঙছুট হয়নি। একটা সংগ্রাম করে যদি সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করতে পারতেন, অন্ততঃ তেমন আশাও যদি থাকতো, তাহলেও বাঙলার শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহিত্য থেকে অনুকরণ করবার মতো, শ্রদ্ধা করার মতো কিছু পেতাম। কিন্তু তা হবার নয়।