বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই ভাড়াখাটা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সকলের না হলেও কারো কারো অল্পস্বল্প শৈল্পিক অঙ্গীকার এবং সামাজিক সুকৃতি ছিলো। কিন্তু শাসক দলের চালকলা খেকো বামুনের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তাদের সমস্ত অঙ্গীকার এবং সুকৃতি প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছেন। বর্তমানে তাদের অবস্থা অনেকটা জয় জয় করিয়া বাড়ে রাজার ব্রাহ্মণের মতো । সরকারী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একসময়ে শিল্পকলার নানা বিষয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সরকারী সুবিধার বলয়ে প্রবেশ করার পর সর্বত্র তাদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। প্রদর্শন করার যতোগুলো মাধ্যম আছে সবখানে তাদের পবিত্র মুখমণ্ডল আলো করে জ্বলতে থাকলো। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় অমৃতবর্ষী বাণী ছড়িয়ে দিতে লেগে গেলেন। সরকারী প্রচারযন্ত্রের অংশে পরিণত হওয়ার পর এই সকল সৃষ্টিশীল মানুষ সম্পূর্ণরূপে সুকুমার অনুভূতি এবং কল্পনাশক্তি রহিত রোবটে পরিণত হয়েছেন। তাদের অবস্থা দলীয় ক্যাডারের চাইতে অধিক শোচনীয়। কারণ ক্যাডারের কাজ চিন্তা করা নয়, নেতা বা দলের হুকুম তামিল করা। কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবীকে চিন্তা করতে হয়। কিন্তু চিন্তার বদলে যদি তিনি চিন্তা করার ভান করেন পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। তাই সরকারী বুদ্ধিজীবীরা যখন বলেন আমরা বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধন করছি, তাদের এই উচ্চারণগুলো সত্য বলে মেনে নেয়ার কোনো যুক্তি নিজেরাও দাঁড় করাতে পারবেন না। সরকারী সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন বলেই যত্রতত্র তারা তোতা পাখির মতো এ বুলিগুলো উচ্চারণ করছেন। তাদের রচনার মধ্যেই মানসিক বন্ধ্যাত্বের চিহ্ন যে কেউ খুঁজে বের করতে পারেন। তারা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলেন শুনে মনে হবে, আবাহনী মোহামেডান টীমের ভাড়া করা বিদেশী খেলোয়াড়দের মতো, তাঁদেরও ভাড়া করে আনা হয়েছে। তারা যখন বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন শুনে মনে হবে, টেক্সট বই থেকে কথাগুলো মুখস্ত করে হাজেরান মজলিশের শ্রোতাদের সামনে বমি করে দিচ্ছেন। তারা যখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার তোলেন, সেটাকে গোদা পায়ের লাথির সঙ্গে তুলনা করা যায়। হুঙ্কার দিয়ে কি মৌলবাদ প্রতিরোধ সম্ভব? তাদের মধ্যে স্বচ্ছ চিন্তা কোথায়? চিন্তার সমর্থনহীন ঢোলা উচ্চারণ এবং শোরগোল কি মৌলবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষেধক বিবেচিত হতে পারে? এই সকল বুদ্ধিজীবীদের অতীত অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং কলঙ্কিত। পাকিস্তান আমল থেকেই রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় তাঁরা ননী মাখন লুট করে এসছেন। তাদের আতীত দিনের কর্মকাণ্ড ঘেঁটে আসল পরিচয় উদ্ঘাটন করা হলে যে কেউ বুঝতে পারবেন তারা কিছুতেই আমাদের জনগণের বন্ধু হতে পারেন না। তাদের উচ্চ কণ্ঠ চিৎকারের মধ্য দিয়ে নির্লজ্জ সুবিধাবাদ ছাড়া অন্য কোনো প্রত্যয়ই ধ্বনিত হয় না। বাহাত্তর সালে তারা যা করেছেন, অধিক জোরের সঙ্গে তার পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন মাত্র।
বাহাত্তর সাল আর ছিয়ানব্বই সাল এক নয়। বাহাত্তর সালে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। মৌলবাদের অবস্থান ছিলো তখন টলটলায়মান। এখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি অনেক বেশি সুসংহত এবং সংগঠিত। মৌলবাদ অক্টোপাশের মতো ক্রমাগতভাবে আমাদের সমাজকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করে ফেলছে। যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। এই রকমের একটি সমীকরণের মধ্যে ফেললে বর্তমান সরকার দলীয় বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। দিনে দিনে প্রতিক্রিয়ার শক্তি যে হারে সংহত হচ্ছে এবং মৌলবাদের প্রতাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তার বিরুদ্ধে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধই রচনা করতে পারেননি। আমাদের জনগণ তাদেরকে চরিত্রহীন, ভ্রষ্ট সুযোগ সন্ধানী এবং আগ্রাসী শক্তির সহায়ক হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। মুখে তারা যাই বলুন না কেনো, আমাদের জনগণকে মুক্তির দিগন্তে পরিচালিত করার কোনো অনুপ্রেরণা তারা দিতে পারেন না যেমন তেমনি আমাদের জাতিকে আপন মেরুদণ্ডের ওপর থিতু হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার কোনো কর্মপন্থার নির্দেশ করতেও তারা সত্যি সত্যি অক্ষম। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাই দেশের একমাত্র বুদ্ধিজীবী নন। যে সকল বুদ্ধিজীবী প্রধান বিরোধীদলটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে মাঠে ময়দানে হুঙ্কার তুলেছেন, যখন তখন যে কোনো উপলক্ষে জমায়েত হচ্ছেন, ভাগে কম পড়ার বেদনাই চীৎকার করে তারা প্রকাশ করে থাকেন। তাদের মনন এবং চিন্তা পদ্ধতি আরো সেকেলে, আরো ভয়ানক। সরকারী বুদ্ধিজীবীদের সামনের দিকে তাকানোর সাহস নেই। কিন্তু এই সকল বুদ্ধিজীবীদের চোখ এবং পা দুই-ই পেছনের দিকে ফেরানো। এক কথায় রাষ্ট্রযন্ত্রের এপাশে ওপাশে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীর অবস্থান তারা জাতি এবং সমাজকে কিছু দেন না, বরং গবাদি পশুর গায়ের এটুলি পোকার মতো সমাজের মানুষের রক্তপান করে নিজেরা মোটা তাজা হতে থাকেন।
দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এবং ছদ্মবেশী প্রগতিশীল এই উভয় গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে না পারলে আমাদের দেশে প্রগতিশীল সংস্কৃতি এবং রাজনীতির উত্থান অসম্ভব। আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির যে অবস্থা তার সঙ্গে খাটে শোয়া মুমূর্ষ রোগীর তুলনা করা চলে। যার অস্তিত্ব আছে বলে শোনা যায়, কিন্তু তার নড়াচড়া নেই। বামপন্থী রাজনীতির এই করুণ পলায়মান এবং জরাজীর্ণ দশা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীন দুর্ভাগ্যেরই ইঙ্গিত নির্দেশ করে। সুতরাং বর্তমান অবস্থা থেকে প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে উঠে আসতে হলে ছদ্মবেশী প্রগতিশীল এবং মৌলবাদী উভয় গোষ্ঠিকেই পরাজিত করতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। এই সময়ের মধ্যে আমাদের সমাজ অনেক জটিল হয়ে পড়েছে, বিরাজমান রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংগঠন, রাষ্ট্রের চেহারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য,ধর্মীয় সামাজিক বদ্ধমত এবং সংস্কারের অনেক কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সংগ্রামের গতিপথটি ছকিয়ে নিতে হবে। যে সকল বিষয় পঁচিশ বছর আগে স্পর্শ করার প্রয়োজন বোধ করিনি, নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশ করার সময় সে বিষয়গুলো নতুন করে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।