.
পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের যে একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিলো, তা এখন ভেঙ্গে গেছে। যে সমাজ ব্যবস্থায় এক ধরণের রবার স্ট্যাম্প মার্কা বুদ্ধিজীবীর সৃষ্টি, যাতে বুদ্ধিজীবীরা কি ভাববেন, কি বলবেন, কি লিখবেন, উপর থেকে বলে দেয়া হতো, পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সে সকল বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে খাঁচার টিয়ে বাইরের উন্মুক্ত আকাশে এলে যেমন হয় সেরকম। বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্ৰেণী। এঁরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করবেন। কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মান শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে। অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগাণ্ডা করিয়ে গোটা দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে। চিন্তাশূন্যতা এবং কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হলো ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।
আমাদের সমাজ এখন একটি দোলাচলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। জনগণ সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করতে পারে এবং সমাজের প্রাচীন সম্পদ সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে সমাজে অধিকাংশের কল্যাণমুখী শোষণহীন নয়া ধন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আবার একটি বিশেষ শ্রেণী গালভরা চটকদার শ্লোগানে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় গাট হয়ে বসে পাকিস্তানী একনায়কদের অনুকরণে চিন্তার স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, কল্পনার স্বাধীনতা, এক কথায় দেশের নামে, জাতির নামে সমস্ত মানবিক স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। ইতিহাসে এই ধরণের ঘটনা অনেক ঘটেছে। ঘটনাচক্রে বাঙলাদেশেও যদি তেমন ঘটে যায়, খুব বেশী অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই ধরণের পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী আমলের বুদ্ধিজীবীরা এই ফ্যাসিবাদেরই সহায়তা করবেন। তার কিছু কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। গোটা দেশের জনসমষ্টির প্রায় সিকি-শতাব্দীর সংগ্রামে এদের কোনো অবদান নেই। এঁরা পাকিস্তানীদেরই সহায়তা করেছেন এবং পাকিস্তানী কর্তারা চিন্তাভাবনার যে মূল্যমান স্থির করে দিয়েছিলেন, তাকেই চরম এবং পরম জ্ঞান করেছেন। যে কোন কারণেই হোক, পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করলেও তাদের দাস্য মনোভাবের কোনোও পরিবর্তন হয়নি। আবার এই দেশে যখন ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তারাই আবার ফ্যাসিবাদের ঘোর সমর্থক হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ইতিহাস এক সময় প্রমাণ করবে পাকিস্তানী আমলের বুদ্ধিজীবীবৃন্দ এবং তাদের শিষ্য সাগরেদরাই হলেন বাঙ্গালী জাতি, বাঙ্গালী সংস্কৃতির শত্রু।
বর্তমান সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করেছেন। এসবকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য যে সকল মানুষ ভাড়া করে এনেছেন, এবং তাঁদের অতীত জীবনের রচনা পাঠ করে বলে দেয়া যায়, এঁদের বুদ্ধি একনায়কের সেবা ছাড়া আর কোনো কিছুতেই খেলেনা। সাম্প্রদায়িক মানুষকে দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার এবং চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে আদিম স্থূল মানুষদের দিয়ে প্রাগ্রসর সমাজদর্শন সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারের ব্যাপারটা রেলগাড়ীতে গরুর গাড়ীর চাকা লাগানোর মতো হাস্যকর প্রয়াসের মতো কি কেমন বিদঘুঁটে ঠেকে না? বর্তমান নেতৃত্বের একটি বিরাট দুর্বলতা হলো, তারা, যে সকল রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছেন বলে ঘোষণা করেছেন, কাজে খাটানোর মতো কোনো সাংস্কৃতিক এলিট সৃষ্টি করতে পারেন নি। সেজন্য পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের ভাড়া করে আনতে হচ্ছে। আর পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীরা সরকারী যন্ত্রের হাল ধরেই নিজেদের পূর্ব সংস্কার এবং অভ্যাস অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় যন্ত্র চালনা করবেন। সম্প্রতি সরকারী, আধা সরকারী এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়া শিক্ষানীতির রূপরেখা নির্ধারণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষকেরা উঁচুপদে চড়বার জন্য কর্তার তোষামোদ এমনকি ছাত্রদেরকেও খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন। পত্রিকাগুলো সেই পাকিস্তান আমলের মতো নোংড়া প্রচারপত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। বেতার এবং টেলিভিশন স্কুল রুচীহীন লোকদের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃজনের তাগিদ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রগতিশীল চাহিদা কোনোও দাম পাচ্ছে না। কর্তার তোষামোদ, ধরতাই বুলি কপচানো, দলাদলি, অবদমিত সাম্প্রদায়িকতা, পদের মোহ এসব প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
আগের মতো দেশ এবং দেশের মানুষের চালাবার দায়িত্ব আল্লাহর কাঁধে ছেড়ে দিয়ে এরা নিরাপদ নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করছেন। অবস্থা যদি এরকমভাবে চলতে থাকে তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদ শক্ত হয়ে বসবে তা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
সরকার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু কিভাবে। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি তো সমাজ সৃজনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই শিক্ষা এবং সংস্কৃতির রূপায়নের জন্যে যে সকল মানুষ আমদানী করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তো আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের প্রিয় অফিসার। এঁদের দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সৃজন কামারকে দিয়ে সোনার গয়না গড়ানোর মতোই অবাস্তব। এ ধরণের মানুষ দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে সরকার কি শিব গড়তে বানর গড়বেন না? সরকার তো সব নয়। জনগণ না চাইলে এই সরকার নয়, কোনো সরকারই তো টিকতে পারে না। দেশের মানুষই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবে এই শেষ কথা। দেশের মানুষের হয়ে যারা ভাববেন, কাজ করবেন, তাঁদের চিন্তা পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত?