বাঙলাদেশের অনেক সাহিত্যিক সাংবাদিক মুখে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু করেছেন উল্টো। সকলের সম্পর্কে আমরা বলছিনে। কোলকাতাতে যেয়ে যারা সুযোগ লুট এবং টাকা ভাগাভাগি করার চক্র-উপচক্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের কথাই বলছি এবং তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। একশ্রেণীর শিক্ষক এবং সাহিত্যিক ভারতে যেয়ে আমেরিকার টাকায় আরামে দিন কাটিয়েছেন। অথচ সে সময়ে মার্কিন অস্ত্রে এদেশের মানুষকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পশুর মতো হত্যা করছে। তারা কি করে এই সময়ে মার্কিন অর্থ গ্রহণ করতে পারলেন, তার রহস্য এখনো অজানা থেকে গেছে। যদি এমন হয় যে, মানবতার খাতিরে মার্কিনীরা এ টাকা দিয়েছিলো, তাহলে সে টাকা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষকেরা পেলেন না কেনো? কয়েকজন ভাগ্যবান শিক্ষক, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মিলে সে টাকা আত্মসাৎ করলেন কেনো? বিপদ তো সকলের জন্যেই। তাই যদি হয়, অন্যান্য শিক্ষক এবং সাংবাদিকরা বাদ পড়ে গেলেন কি করে? কোনো কোনো শিক্ষক, সাংবাদিক তো প্রত্যক্ষভাবে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন।
বাঙলাদেশের কিছু কিছু অধ্যাপক এবং সাহিত্যিকের কথা জানি যারা কোলকাতা গিয়ে রাতারাতি ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানী সৈন্য তাঁদের কোলকাতায় যেয়ে খুন করবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তবু তারা ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এর প্রয়োজনটা ছিলো কি? প্রয়োজন ছিলো বৈকি। তা দু’ধরনের। এক, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে বাঙলাদেশ সত্যি স্বাধীন হবে। যদি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকেই যায়, আর তাঁদের যদি দেশে ফিরে আসতে হয়, বলতে পারবেন তারা পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে কিছু করেন নি। দুই নম্বর হলো, ছদ্মনামে সত্যি মিথ্যে গল্প ফেঁদে ভারতীয় জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণ করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার। যেহেতু ছদ্মনামে লিখেছেন তাই দেশের কেউ তাঁদের কোনো কার্যকলাপের প্রতি চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। যারা এরকম দুর্বলচিত্তের এবং যুদ্ধের সময়ে এই দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন বাঙলাদেশে এসে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে কিভাবে দাপট দেখান এবং সরকার কোন যুক্তিতে তাদের টেনে তুলে উঁচুপদে বসালেন? এ ধরণের অপকর্ম শুধু লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা করেছেন এবং অন্যরা একেবারে খাঁটি ছিলেন সে কথা কিছুতেই সত্যি নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেরা যা করেছেন ঠিকমতো প্রকাশ পেলে লোম দাঁড়িয়ে যাবে। তা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর।
.
বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনন-রীতি এবং চিন্তন পদ্ধতির মধ্যে, আমাদের কবি সাহিত্যিকদের রচনায় একটা বিরাট গুণগত পরিবর্তন খুবই প্রত্যাশিত ছিলো। সমগ্র বাঙ্গালী জাতির লিখিত ইতিহাসে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো তাৎপর্যবহ কোনো ঘটনা নেই। এই-ই প্রথম বাঙ্গালী জাতি একটি রাষ্টের জন্ম দিয়েছে। সে রাষ্ট্রের আঙ্গিক এবং প্রকরণ যাই হোক না কেননা, বাঙলার ঐতিহাসিক অহং-এর এই অ্যুদয় যে সম্পূর্ণ অভিনব ঘটনা, তার গুরুত্ব কিছুতেই ছোটো করে দেখার উপায় নেই। একটি নবীন রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে বাঙলাদেশের পরিচিতি চিহ্ন তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের, সাংবাদিকদের, কবি-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারার মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তারা সে দাবী মিটাতে পারছেন না।
আমাদের রেডিও-টেলিভিশনে যাদের চেহারা দেখি, কণ্ঠস্বর শুনি, আমাদের কাগজগুলোতে, সাময়িকী পৃষ্ঠায় যে সব রচনা প্রকাশিত হয়, দেখে মনে হয়, কোনোরকমে মুখরক্ষা করতে পারলেই যেনো সকলে বেঁচে যান। যে নতুন কাল সামনে এসেছে, সে কালের অন্তর্বাণী কি তা উপলব্ধি করে জনসাধারণের সামনে এঁরা যথাযথ ভাবে উপস্থিত করতে পারছেন না। তাঁদের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গগুলো নবযুগের আহবানে সাড়া দিতে পারছে না। তাই তারা জোরে চীৎকার করছেন এবং চীকারের অন্তরালে তাদের চিন্তাশূণ্যতা এবং মানসিক বন্ধ্যাত্ব ঢেকে রাখার অন্তহীন কসরত করে যাচ্ছেন। এই ভদ্রলোকদের, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘ভালগার’ তা ছাড়া কিছু মনে করার উপায় নেই। কাগজগুলো খুললেই দেখা যাবে লেখক-কবিরা সকলে পরামর্শ করে কলস কলস অশ্রু বিসর্জন করছেন, যেনো স্বাধীনতা উত্তর বাঙলাদেশে লম্বা টানে বিলাপ করাটাই সবচেয়ে করণীয় কাজ। বিলাপ একটি জীবন্ত সম্ভাবনাময় জাতির সব চাইতে বড়ো শক্ত। কারণ, যে জীবন্ত, তার অতীতের ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে খেদ করার খুব একটা বেশী সময় নেই। অতীতের চাইতে তার কাছে ভবিষ্যণ্টাই মূখ্য। আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের হালফিল প্রকাশিত রচনায় ভবিষ্যতের ইশারাটি কোথায়? কাগজ-গুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত যে সকল রচনা প্রকাশিত হচ্ছে তাতে, স্বাধীনতা সগ্রামের মূখ্য বৈশিষ্ট্যটি ফুটিয়ে তোলার বদলে স্থূলতাকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই ধরণের রচনার সার্থকতা কোথায়? রেডিও টেলিভিশনে প্রতিদিন নয়া শিক্ষা, নয়া সংস্কৃতির নামে যে সকল ভদ্রলোক তারস্বরে চীকার করে রুচী পীড়িত করেছেন, তার দরকারটাই বা কি? সভা-সমিতিতে প্রতি মাসে যে সকল পণ্ডিত মাথা চুলকে চতুঃস্তম্ভের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছেন এবং জাতিকে, তরুণ সমাজকে হেদায়াত করে যাচ্ছেন, তাঁদের কথা শুনে কারই বা মনে ভাবান্তর আসে? কেই বা এই আত্মরতিপরায়ন পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস করে? না করাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা এক বছর আগেও এই সকল ভদ্রলোক প্রকাশ্যে গণসংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। এই লেখক-কবিদের বেশীর ভাগই সংহতির নামে গদগদ হয়ে যেতেন। আর, সি, ডি, ট্যুর ইত্যাদির সুযোগ গ্রহণ করার জন্য দরকার হলে পশ্চিমা হুজুরদের জুতো পালিশ করে দিতেন। তারাই আবার প্রকাশ্যে মাঠে নেমে চীকার করে বলছেন, পাকিস্তানী দস্যুরা নিপাত যাক, তারা আমাদের তিরিশ লাখ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে ইত্যাদি। সেই যে ষোলোই ডিসেম্বরের পর থেকে বলতে শুরু করেছেন এখনো সমানে বলেই চলেছেন। আমাদের মহারথীদের একটিই বৈশিষ্ট্য, তারা যা করেন, প্রকাশ্যেই করেন। পাকিস্তানীরা তো নিপাত গেছে, তিরিশ লাখ মানুষ তো মেরেই ফেলেছে এবং আপনারা বেঁচে যখন আছেন, সে মরা মানুষের নামে মরা কান্না কেঁদে কি আর লাভ? যারা বেঁচে আছে তাদের কথাটি একবার ভেবে দেখুন দেখি। মরলে তো সকল সমস্যা চুকে বুকে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকার হাজার লেঠা। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বাঙলাদেশের এই জীবিত মানুষদের সম্বন্ধে কোনও ভাবনা-চিন্তা করতে রাজী নন। কেননা তা করলে ঘাড়ে অনেক দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে, অনেক ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে। চাই কি কর্তৃপক্ষের শত্রুও হতে হবে। সুতরাং কার বা গোয়ালে কে দেয় ধোয়া। এতে করে হচ্ছে কি? কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী বাঙলাদেশের শুধু নিজেদের অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখছেন না–একই সঙ্গে নতুন চিন্তা, নতুন কল্পনা এবং বুদ্ধিবৃত্তির নতুন প্রকরণেরও বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক আদর্শের বদলে আরেকটি রাজেৈনতিক আদর্শ, এক ধরণের রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরেক ধরণের রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিতে আসতে বাধ্য। পাকিস্তানী সংস্কৃতির স্থলে নতুন প্রাণবন্ত এবং সৃজনশীল বাঙ্গালী সংস্কৃতির মহীরুহে শত শত নতুন মুকুল মেলবে। এটা প্রত্যাশা করা একটুও অস্বাভাবিক নয়। যদি তা বাস্তবে পরিণত না হয়, তাহলে আমরা কোনও দিন মনে প্রাণে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা তুলতে পারবো না। একটি যুদ্ধোত্তর সমাজের নানা অসুবিধা, অপূর্ণতা, উত্তেজনা এবং ভুল বুঝাবুঝির মধ্যেও নতুন সংস্কৃতির বুনিয়াদটি ভেতর থেকে সৃজিত হচ্ছে কি না তার প্রতি দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় আমাদের যারা সুধীজন বলে কথিত, তাদের চিন্তা স্বপ্নের যে ছায়াপাত–লেখায়, গল্পে, বক্তৃতায় দেখতে পাচ্ছি, তাতে নতুন সমাজের অঙ্কুরটি নেই। আমাদের প্রবীণ এবং অনতি প্রবীণেরা একেবারে বেমালুম ফেল মেরে যাচ্ছেন। আমাদের সমাজের যে নতুনতরো মানব সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন, যে নতুনতরো মূল্যবোধের অঙ্কুরণ করার কথা এবং দৃষ্টিতে নতুন ভঙ্গী আসার কথা, তার লক্ষণগুলো ক্রমশঃ সুদূরে বিলীয়মান হচ্ছে। চারদিকে চিন্তা শূন্যতার নৈরাজ্য এবং চাটুকারিতার চক-চকানি। এরই মধ্যে আমাদের সৃজনশীলতা রেশমের ফাঁসে আটকা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, বাঙলা একাডেমী, সরকারী পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন এসব আবার প্রতিক্রিয়ার দুর্গ হয়ে উঠেছে এবং এই চক্র দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। এর মধ্যে পড়ে তরুণদের কল্পনা, বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তা প্রতিদিন কলুষিত হচ্ছে।