বুঝতে কষ্ট হয় না আমাদের লেখকেরা কেন কল্পনা করতে পারেন নি, কেন স্বপ্ন দেখতে পারেন নি যে, বাঙলাদেশ দু’এক বছরে স্বাধীন হবে। কল্পনা করা এবং স্বপ্ন দেখাতো আসল মস্তিষ্কের কাজ। আমাদের তারা বাস্তব কাজে ব্যস্ত ছিলেন–সেটি টাকা রোজগারের কাজ তাও বাঙলাদেশকে বেচে দিয়ে। ভুল হয়ে গেছে। সুতরাং পত্র পাঠ ক্ষমা করে দিন। অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়ে আরো দুয়েক দাও মারতে দিন। ধন্য বাঙলাদেশের লেখক।
.
বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বাঙলাদেশের গণমুক্তি সংগ্রামে কি আবদান রেখেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে যে সকল কবি সাহিত্যিক কোলকাতা গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসে মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে সকলের সামনে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাদের সেখানকার কাজকর্মের ধারা সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতের বুদ্ধিজীবীদের সামনে যে পরিচয় রেখে এসেছেন তা আমাদের জাতির চূড়ান্ত লজ্জা এবং কলঙ্কের বিষয়। সকলের সম্পর্কে বলছিনে। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই কে কার চাইতে লোভী এবং গবেট তা প্রমাণ করার জন্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন।
জাতির এতোবড়ো সংকটের মুহূর্তে কোলকাতা প্রবাসী কবি সাহিত্যিকেরা আমাদের শরণার্থী জনগণের সঙ্গে কোনোরকমের একাত্ম বোধ করার তাগিদ আদৌ অনুভব করেননি। তাদের বেশির ভাগের বক্তৃতায়, কথায়, লেখায় জনগণের সঙ্গে এক সারিতে নেমে আসার আবেগ বিকীরিত হয়নি। এই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলদার বাঙলাদেশে থাকলে বেয়নেটের গুতোর চোটে এবং লোভের বশবতী হয়ে যে ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করতেন, একইভাবে বাঙলাদেশকে সমর্থন করেছেন। ঘটনাচক্রে তাদের কোলকাতা যেয়ে কয়েক মাস উদ্বেগে কাটাতে হয়েছিলো–মুক্তি সংগ্রামী বলে পরিচয় দেয়ার তাৎপর্য এটুকুই–বেশি কিছু নয়।
এই সময়ে বাঙলাদেশের জনগণ যারা পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, নিহত আত্মীয় পরিজনের স্মৃতি বুকে নিয়ে, সর্বহারা অবস্থায় ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং পশ্চিম বাংলার নগর জনপদে জীবন্ত প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলো–ভারতীয় এবং বিদেশী সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক আর বিশ্বের মানববাদী মানুষ যাদের প্রাণ রক্ষা করার জন্যে পথে নেমে এসেছিলেন, বাঙলাদেশের লেখক-সাহিত্যিক কি তাদের এই দুর্গত অবস্থার প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে একটি কথাও বলতে পেরেছেন? দেখে শুনে আমাদের ধারণা হয়েছিলো, বাঙলাদেশের লেখক সাহিত্যিকদের হৃদপিণ্ডগুলো প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সেই সময়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের যে অসহনীয় অবস্থা ছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে হাজার হাজার স্বাধীনতা প্রেমিক কিশোর, যুবক এসে সমবেত হচ্ছেন। কিন্তু শিবিরে অতো লোককে স্থান দেবার ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে তরুণেরা, যাদের বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গাছতলায় রাত কাটাচ্ছেন, রোদে পুড়ছেন এবং বৃষ্টিতে ভিজছেন। কারো কারো অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের তুলনা করা যাক। বুদ্ধিজীবীরা তখন কি করছেন? দিল্লী-হিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাঙলাদেশের গণহত্যার নাটকীয় বর্ণনা দিয়ে নিজেদের রুটি রুজির ব্যবস্থাটা পাকাঁপোক্ত করে নিচ্ছেন, বিদেশ থেকে আসা সাহায্যের অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করছেন। শিক্ষক-সাংবাদিক-সাহিত্যিক এবং উকিল-মোেজার যারাই গিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ এইভাবেই কোলকাতা থেকে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশেষ মানসিকতা দেখে পশ্চিম বাংলার লোকেরা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। বিদেশ থেকে যে সাহায্য এসেছে তাও উদারসাৎ করেছেন তারাই। অথচ সাহায্যের যাদের দরকার সব চাইতে বেশি তারাই বঞ্চিত হয়েছেন। কোলকাতা শহরেও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের একটি সুবিধাববাগী শ্রেণী হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। বিদেশ থেকে শিক্ষকদের দেয়ার জন্য টাকা-পয়সা সাহায্য এসেছে, সে সাহায্য পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের কতিপয় শিক্ষক। প্রাইমারী স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের কাছে সে সাহায্য পৌঁছায়নি বললেই চলে। ঢেঁকি যে মক্কা গেলেও ধান ভানে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দেখে আমাদের সে ধারণা অধিকতরো সুদৃঢ় হয়েছে। কোলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলোতে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, পড়লে যে কোন স্বাধীনতাকামী আত্মবিশ্বাসী মানুষের মাথা আপনা থেকেই হেট হয়ে আসার কথা। আসল পরিসংখ্যান রিপোর্ট আগে প্রকাশিত হয়নি। তবু বলতে হয়, আনুমানিক তিরিশ লাখের মৃত্যু, প্রায় এক কোটি মানুষের দেশ ত্যাগ এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ছ’কোটির মতো মানুষের বন্দীদশা দেখে বুদ্ধিজীবীরা কোন রকম বিচলিত হয়েছিলেন বলে, একটুও মনে হয় না। যদি তাই হতো তা হলে কি করে বাঙলাদেশের সাংবাদিকেরা কলকাতার কাগজে মনগড়া কাহিনী রচনা করেন? কি করে লেখকেরা সভা-সমিতিতে এন্তার মিথ্যা কথার তুবড়ি ছোটান– তাও আবার এমন মিথ্যা যার সঙ্গে স্বাধীনতা সগ্রামের সামান্যতম সংযোগও নেই।