অথচ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পর পর দেশের জাগ্রতচিত্ত লেখক কবিদের প্রতি অত্যন্ত ভরসার দৃষ্টিতে তাকাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। গণতন্ত্রের অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে প্রক্রিয়াটি গোড়াতেই বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরাই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলো অধিকার করে বসলেন। সরকারী আনুকুল্য পেয়ে তারা দেশের সংস্কৃতিকে বয় বেয়ারার মতো ইঙ্গিতে যে দিকে ইচ্ছে চালাতে লাগলেন। বাহান্ন সালের রক্ত থেকে যাদের জন্ম, সে সকল তরুণেরাও এসে সুযোগ সুবিধার জন্য এই পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে হাত মেলালেন। মোটের ওপর লেখার ব্যাপারটিই সুযোগ দেয়া এবং সুযোগ গ্রহণ করার কাজ হয়ে দাঁড়ালো। আয়ুব খান এসে এই সমস্ত নতুন পুরোনো লোকদের নিয়ে লেখক সংঘ বানালেন।
লেখক সংঘ মানে লেখকেরা কি ভাববেন, কি চিন্তা করবেন, কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন জঙ্গীলাট নির্দিষ্ট করে দেবেন। তিনি যা বলবেন–এঁরা তা লিখবেন। বিনিময়ে লেখকদের দেয়া হলো অঢেল সুযোগ-সুবিধা। তাদের জন্য আদমজী পুরস্কার, ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। সেদিন বাঙলাদেশে একজন লেখকও লেখকের সুস্থ এবং স্বাধীন মননশীলতার বিরোধী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরুদ্ধে ট্যু শব্দটি করেননি। বরং সকলে বগল বাজিয়ে আপনা থেকেই এগিয়ে এসে অংশ গ্রহণ করেছেন। খ্যাতনামা পশ্চিমা দালালদের কথা বলে লাভ নেই। যারা কমিউনিস্ট, সর্বহারার আন্দোলনে বিশ্বাসী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদেরও অনেককে দেখা গেছে ধনপতিদের হাত থেকে অর্থ পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে জীবন ধন্য মনে করেছেন। চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীলরা তো প্রতিক্রিয়াশীল-সরকারের সহযোগীতা করতো সেটা জানা কথা। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিশীল এবং কমিউনিস্টদেরও দেখা গেছে কার্যত জঙ্গীলাটের সহায়তা করতে। আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং হাবীব ব্যাংক পুরস্কার যারা গ্রহণ করেছেন, সে তালিকাটা আমাদের সামনে খোলা রয়েছে। তাতে এমন ক’জন মানুষের নাম রয়েছে, যাদেরকে এক শ্রেণীর মানুষ দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। আজকের বাঙলাদেশের যে সকল খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক আছেন, তাদের বেশির ভাগই একভাবে না একভাবে সামরিক সরকারের সহযোগিতা করেছেন। এঁদের সকলে কি আয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেননি? শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এঁদের কেউ কেউ জীবনপাত করেছেন বলে শোনা যায়–আদমজী, দাউদের দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করে কোন শ্রেণীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা তারা কামনা করেছিলেন? তাহলে দেখা যাচ্ছে বাঙলাদেশে সৎ-লেখক ও সৎ-বুদ্ধিজীবী ছিলেন না বললেই চলে। মুখে সর্বহারার রাজনীতি কিন্তু কাজের বেলায় বাঙ্গালী সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করেছেন অনেকে।
বি, এন, আর-কে দোষ দেয়া হয়ে থাকে–দোষ দেয়া হয় শুধু হাসান জামানকেই। কিন্তু বি, এন, আর-এ যাননি কোন লেখক? সকলেই টাকা নিয়েছেন–আবার জনগণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সকলেই বি, এন, আর-এর গোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। চমৎকার রসিকতা। বাঙলাদেশের সমস্ত নামকরা কবি-সাহিত্যিক যারা সোনার বাঙলা নামে কেঁদে-কুটে বড় বড় পদ দখল করে বসেছেন–তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগই যে অকাণ্ড কুকাণ্ড করেছেন তার ভুরি ভুরি প্রমাণ হাজির করা যায়।
লেখক সংঘ, বি, এন, আর, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তি যে শুধু নষ্ট হয়েছে তা নয়–এ সবের মাধ্যমে আয়ুব খান একটি যুগের বিবেককে হত্যা করেছে, চিন্তাকে কলুষিত করেছে। তরুণ সমাজের সামনে শ্রদ্ধা করার মতো কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলোনা–এখনো নেই। কাউকে শ্রদ্ধা করতে না পারা যে কতো বড়ো অভিশাপ একমাত্র ভূক্তভোগীই উপলব্ধি করতে পারেন। রেডিও, টেলিভিশন, লেখক সংঘ, প্রেট্রাস্ট ইত্যাদি আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও এ সবের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিলো।
আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে নোংড়া মানুষ। তারা দেশকে যে হারে ফাঁকি দিয়েছেন কোনো কালোবাজারীর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। তাঁদের ছদ্ম আদর্শবাদিতার সঙ্গে গণিকাদের সতীপনার তুলনা করা যায়। কে না জানে পাকিস্তান-ভারত যে যুদ্ধ হয়েছিলো তা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ! সেই যুদ্ধে অনেকটা আসোয়ান ড্যামের টাকা খরচ হয়েছিলো বলা হয়ে থাকে। এই আসোয়ান ড্যাম ভালো করে তৈরি করার টাকা ঋণ না পেয়ে প্রেসিডেন্ট নাসের রাতারাতি মার্কিন ব্লক থেকে সোভিয়েত ব্লকে চলে গিয়েছিলেন। এমনি একটা যুদ্ধকে নিন্দা করার মতো একজন কবি, একজন লেখক ছিলেন না। অথচ পশ্চিম বঙ্গে এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেননি বলে প্রায় আশিজন বুদ্ধিজীবীকে কারাবরণ করতে হয়েছিলো। আমাদের কবিরা, আমাদের লেখকেরা কি করেছেন? ভারতকে বাক্যবাণে হারিয়ে দেওয়ার জন্য কষে হিন্দু নিন্দা করেছেন। খুবই বুক ফুলিয়ে গদগদ ভাষায় বলেছেন, দুনিয়াতে মুসলমানেরাই আসল জাতি! ভাগ্যের কি পরিহাস, সে কবি-সাহিত্যিকেরা এখন ভারতীয় পণ্ডিতদের সার্টিফিকেট এনে বাঙলাদেশে আসন পোক্ত করার জন্য কোলকাতা ছুট দেন। আগে যে বইগুলো লিখেছেন কোন রকমে গুম করে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে রু করেছেন–এবার অসাম্প্রদায়িকতার কেতাব লিখবেন।