আয়ুব খানের উদ্ভাবিত পদ্ধতি সৎ সাংবাদিকতাকে আরো নানা দিক দিয়ে ব্যাহত করেছে। বিশেষ করে পত্রিকাটির নাম করলাম এ কারণে যে, পত্রিকাটিতে আমাদের দেশের বেশ ক’জন প্রতিভাবান মানুষ চাকুরী নিয়েছিলেন। তাঁদের রচনা, রচনারীতি, চিন্তাধারা এবং প্রগতিশীল ভূমিকার প্রতি আমাদের দেশের জনগণ শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিভা এবং যোগ্যতা দিয়ে খান সাহেবের দালালীই করেছিলেন। প্রতিভাহীন ব্যক্তির ক্ষতি করার ক্ষমতা অল্প। প্রতিভাবান ব্যক্তি বুদ্ধি খাঁটিয়ে ইচ্ছে করলে খৈ খাওয়ার জন্য ধানের গোলায় আগুন লাগাতে পারে। পত্রিকাটির বেলায়ও তেমনটি হয়েছে।
অন্যান্য সাংবাদিকদেরও আয়ুব খান নানা পদ্ধতিতে উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করেছেন। সাংবাদিকদের জন্য বাড়ী, জমি, গাড়ী এই সব কিছুর ব্যবস্থা আয়ুব রাজত্বেই হয়েছে। সাংবাদিকদের বাড়ী হবে না, গাড়ী থাকবে না–তেমন কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বলতে চাইছি আয়ুব রাজত্বে সাংবাদিকদের মধ্যে হঠাৎ এমন একটা গাড়ীওয়ালা, বাড়ীওয়ালা, পয়সাওয়ালা সাংবাদিক শ্রেণী গজিয়ে উঠলো–যাদের এই আকস্মিক সমৃদ্ধির কারণে জনগণের দুর্দশা বেড়েছে। যে সমাজে জনগণের মাথাপিছু আয় এক পয়সা বাড়েনা–সে সমাজে যদি সাংবাদিকেরা রাতারাতি বড়োলোক হয়ে উঠেন, তাহলে কথাটা কি এই দাঁড়ায় না–তারাও জনগণের ওপর শোষণের কাজে সাহায্য করে আসছেন। প্রেস ট্রাস্টের অন্তর্ভূক্ত সাংবাদিকদের নয় শুধু অনেক সময় চৌকষ বিরোধী দলীয় পত্রিকার সাংবাদিকদেরও পয়সা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে প্রতিবাদের ধার ভেঁতা করে দিয়েছিলো। মোট কথা আয়ুব রাজত্বে মুষ্টিমেয় সাংবাদিকদের নিয়ে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী পুরোপুরি সৃষ্টি হয়েছিলো। তারা আয়ুব খানের দালালী করেছেন, সৎ সাংবাদিকতার ক্ষতি করেছেন, প্রদেশের সংবাদপত্র শিল্পের প্রসারে পরোক্ষে বাধা দিয়েছেন এবং সংখ্যাধিক সাংবাদিকের মতামতের স্বাধীনতা এবং রুজী রোজগারের স্বাধীনতায় ছলে-বলে-কলে-কৌশলে হস্তক্ষেপ করার কাজে সামারিক সরকারের সহায়তা করেছেন। কারণ, যেভাবেই হোক না কেননা, যারা অত্যাচারী সামরিক সরকারের সহায়তা করেছেন এবং তা করে টাকাকড়ির মালিক হয়েছেন, তাঁরা যে গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের ক্ষতি করেছেন, তা আর নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ বলে থাকেন গোবেচারা শিক্ষকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেচারারা অবস্থার শিকার । চমৎকার যুক্তি। কিন্তু এই গোবেচারারাই পেছনে একটা শক্ত খুঁটি পেলে করতে পারেন না হেন কর্ম নেই। গত তেইশ বছরের একটা হিসেব কষে দেখানো যেতে পারে। শিক্ষকেরা স্কুল কলেজ পাঠ্য টেক্সট বইতে কি পরিমাণ মিথ্যে লিখেছেন, প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি কিভাবে সাধন করেছেন, কিভাবে জাতীয় চেতনার ধারাকে বিপথগামী করেছেন; তা অল্প কথায় শেষ করার নয়। সব শিক্ষক সম্পর্কে বলছিনে, যাদের সম্পর্কে বলছি, তাদের কাছ থেকে জাতি সুষ্ঠু কৃষ্টি-কালচার ভিত্তিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আশ্রয়ী শিক্ষা পদ্ধতি আশা করেছিলো। কিন্তু তারা তা করেননি এবং এই না করার জন্য লাভবান হয়েছেন।
আয়ুব খান শিক্ষকদের মধ্যেও একটা শ্রেণী গড়ে তুলেছিলেন। এই বিশেষ শ্ৰেণীটিকে নানা উপায়ে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একান্ত অনুগত রেখেছিলেন। আমাদের দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক যেভাবে রাজার হালে থাকেন তার সঙ্গে আশেপাশের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের বাস্তব অবস্থার তুলনা করে দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেদেশে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকেরা একবেলা খেতে পাননা, বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন পান না, সে দেশে এক শ্রেণীর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিভাবে বাড়ী-গাড়ীর মালিক হতে পারেন? বাড়ী থাকাটা খারাপ নয়, কিন্তু যে টাকা দিয়ে ওসব করা হয়েছে, সে টাকা অর্জনের পদ্ধতিটাই সামগ্রিকভাবে শিক্ষক সমাজ এবং দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। সাধারণ অর্থে যাদের আমরা কলাবরেটর বলি এঁরা তা নন। এঁরা ভিন্নভাবে সামরিক সরকারের সহায়তা করেছেন। কলাবরেটর শিক্ষকদের সাক্ষাৎ প্লেগের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, এই ধরণের শিক্ষকদের বলা উচিত ক্ষয় রোগ। এই রোগ দিনে দিনে একটু একটু করে জীবনী শক্তি ক্ষয় করে একদিন হৃদপিন্ড আক্রমণ করে বসে। এখনও এই শ্রেণীটির হাতেই শিক্ষার দায় পুরোপুরি ন্যস্ত রয়েছে।
.
কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার জ্বণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। জাতীয় জীবনে যা ঘটে গেছে অতীতে, তাঁরা ভাবের আবেশে সামনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ফেলেন– এই-ই হতে যাচ্ছে এবং এই-ই হবে। কিন্তু বাঙলাদেশের তেমন কবি, সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই। আমাদের যে ক’জন নামকরা কবি কিংবা সাহিত্যিক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগের প্রতি মানুষ খুব শ্রদ্ধেয় মনোভাব পোষণ করে না। বাংলাদেশের আজকের দিনে লেখকেরা কবিরা সামাজিক দিক দিয়ে বোধ হয় সম্মানহীন জীব। তারা পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার যোগানদার, রেডিও টেলিভিশনের অঙ্গসজ্জা এবং বিকৃত রুচিহীন নিরস পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার অধিক কিছু নন। লেখক-কবি একটা জাতির সংগ্রাম, সাধনা চিত্তসম্পদ আবেগে ধারণ করেন এবং চেতনায় লালন করেন। কিন্তু বাঙলাদেশের লেখকদের ক্ষেত্রে তা সত্য হয়নি। বাঙলাদেশের লেখকেরা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেননি–তাই সমাজও লেখককে শ্রদ্ধা করে না। সমাজে লেখকদের কোন ইমেজ নেই বললেই চলে।