আংশিকভাবেও যদি আমাদের জাতি এই মনোভঙ্গী আয়ত্ব করতে না পারে, তাহলে বলতে হয় আমাদের বর্বর-দশা এখনো কাটেনি। ভাষা আন্দোলনের পরে বাঙ্গালী সংস্কৃতির চর্চা হতো পোকায় কাটা প্রাচীন কাব্য অনুগত ছাত্রদের ফিসফিস করে পড়ানোর মধ্যে, অবসরভোগী চাকুরেদের অলস বিশ্রাম্ভালাপে, মেদবহুল বাঙলার অধ্যাপকের রেডিও টকের বাগবিস্তারে এবং রবীন্দ্রবিলাসী মহিলাদের পূর্ণিমা বাসর রচনায়। কখনো কখনো দুয়েকটি ব্যতিক্রমী পত্র পত্রিকা চোখে পড়তো। গোটা দেশের বিচারে তা আর কতো।
রাজনীতি আর সংস্কৃতি আলাদা হয়ে পড়লেও বাঙলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি এমনভাবে প্রাণ স্পন্দনহীন হয়ে থাকার কথা ছিলো না। যেটুকু প্রাণের লক্ষণ ছিলো মার্কিন ডলার একেবারে থেতলে দিয়ে গেলো। মার্কিন দূতাবাস বাঙলাদেশের অধ্যাপক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকদের চড়া দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলো। যে লেখক একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস প্রকাশ করে বছরে দু’শো টাকা আয় করবার ভরসা করতে পারতেন না, সেই একই লেখক মার্কিন বইয়ের সের মাপা অনুবাদ করে মাসে আড়াই হাজার কামাতে লাগলেন। মার্কিন দূতাবাস বেছে বেছে সমাজতন্ত্রীদের বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা বই-ই অনুবাদ করাতো। এ পর্যন্ত মার্কিনীরা হাজার হাজার বই অনুবাদ করিয়েছে। তার মধ্যে আঙ্গুলে গুণে বলা যাবে–কটি সৎ সাহিত্য। সে কটিও অনুবাদ করিয়েছে পাছে লোকে মনে করে মার্কিনীরা কেবল প্রোপাগাণ্ডাই অনুবাদ করায়। বাঙলাদেশের যে সমস্ত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সমালোচকের নাম এখন হামেশা শোনা যায়, তাদের শতকরা আশি ভাগই মার্কিনী প্রচারের অনুবাদ করেছেন। এটা খুবই দুঃখের কথা যে আমাদের সংস্কৃতির যারা শ্রদ্ধেয় লোক বলে খ্যাত অনেকেই মার্কিনী অর্থের বিনিময়ে মানসিক দাসত্ব করেছেন এবং তা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও গণ সংগ্রামের বিপক্ষে গেছে। আমেরিকান দূতাবাসের সহজ টাকা না পেলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মানসিক সগ্রামে প্রবৃত্ত হতেন। তা আমাদের শিল্প-সাহিত্যে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র উম্মোচন করতো। আর অনূদিত বইগুলো মার্কিনীরা জ্ঞান বিতরণের ছল করে স্কুলে-কলেজে এবং সাধারণ পাঠাগারসমূহে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের গণ সংগ্রাম বিরোধী বই অধিক পাঠের ফলে আমাদের জনগণের চেতনা, চিন্তা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছে।
তালিকা যদি ক্ষুদ্র হতো নাম উল্লেখ করতামঃ কোন্ খ্যতনামা কবি, কোন্ নামী অধ্যাপক আমেরিকার টাকায় দেশের বিরোধিতা করলেন! কোনো রকমের দ্বিধা না করেই বলে দেয়া যায়, দু’চারজন বাদে আজকের বাঙলাদেশের নামকরা শিক্ষক সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বেশীর ভাগই জীবনের একসময়ে না এক সময়ে মার্কিন প্রচার অনুবাদ করেছেন। এমন নজীর আমাদের আছে, কেউ কেউ দুর্নামের ভয়ে নিজের নামের বদলে মেয়ের স্বামী, ছেটো ভাই এবং অর্ধাঙ্গিনীর নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।
বাঙলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দের দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা ও দূরদর্শীতার অভাবের দরুণ ধীরে ধীরে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক না হয়ে দুটি আলাদা জলঅচল কুঠুরীতে পরিণত হলো। রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টারদের, উড়নচণ্ডী কবি সাহিত্যিকদের বিলাসের, চিত্তবিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিলো। এই সময়ে জঙ্গীলাট আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেন।
তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রী শ্রেণী সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন আমলা এবং টাউট শ্ৰেণী। আয়ুবের সিংহাসন ধরে ঝুলে থাকা এই শ্রেণী সমূহের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও একটা শ্রেণী একনায়ক নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে নিলেন। আয়ুব খানের রাজত্বে বুদ্ধিজীবীরা একটা আলাদা শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণ একটা শ্রেণী হিসেবে মাথা তুলেছে তা নয়-জঙ্গীলাট নিজের প্রয়োজনে বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কারবার করেন এমন মানুষদের মধ্যে মাথামোটাদের বেছে নিয়ে আলাদা একটা শ্রেণী দাঁড় করালেন।
শিক্ষকদের মধ্যে, সাংবাদিকদের মধ্যে, সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি সুবিধাভোগী কতিপয় মানুষ বাছাই করলেন। তাঁদের বাড়ী, গাড়ী, অধিক মাইনে, বিদেশ ভ্রমণ এবং পারিতোষিকের সুযোগ-সুবিধে করে দিলেন। হিসেব করলে দেখা যাবে, যে সময়ে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা নিকৃষ্টতম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই সময়েই এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী অঢেল সরকারী সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে রাতারাতি চেকনাইওয়ালা হয়ে উঠেছেন। আয়ুব রাজত্বে দুর্নীতিবাজ মৌলিক গণতন্ত্রী দেশের জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে পোষা যেমন রেয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তেমনি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের পুষে সাংস্কৃতিক উজ্জীবন বন্ধ করাও একটা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আয়ুব খান এমন কতিপয় চেকন-মোটা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন, যার ফলে অধিকাংশ চক্ষুষ্মন ব্যক্তি চড়া দামে আত্ম বিক্রয় করতে বাধ্য অথবা প্রলুব্ধ হলেন।
সাংবাদিকতার কথাই ধরা যাক। সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে হাত করার জন্যে আয়ুব খান প্রেস ট্রাস্ট, ফিচার সিণ্ডিকেট ইত্যাদির জন্ম দিলেন। অন্যান্য দৈনিক কাগজে যে পরিমাণ মাইনে দেয়া হয়, তার দুগুণ তিনগুণ মাইনে প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকার কর্মচারীদের দিতে থাকলেন। জঙ্গীলাট বেশী মাইনে দিতে রাজী হয়েছিলেন এ কারণে যে, টাকা দিয়ে তিনি ধারালো কলমগুলো কিনে নিতে পারবেন। দেশের মানুষের আস্থা ছিলো যাদের সাংবাদিক সততায়, যারা লেখক এবং কবি হিসেবে, বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, তারাই কিনা হয়ে গেলেন আয়ুব খানের মিলিটারী গেজেটের কেরানী। সেদিন অধিক পয়সার লোভে যারা আয়ুব খানের দালালী করেছিলেন, আয়ুব খানের আয়ুবনামা অনুবাদ করেছিলেন, তারা আজ কি করে, কিসের বলে স্বাধীন বাঙলাদেশে রাতারাতি মস্ত দেশপ্রেমিকে পরিণত হলেন ভাববার বিষয়। একটা কথা বললে শত্রুতার মতো শোনাবে–কিন্তু আসলে সত্যি। প্রেস ট্রাস্টের একটি বাঙলা পত্রিকা জটিল এবং সূক্ষ পদ্ধতিতে বাঙলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক সতোর যে ক্ষতি করেছে, তার জুড়ি নেই। প্রেস ট্রাস্টের অপর পত্রিকাটিও ক্ষতি করেছে। কিন্তু ইংরেজী হওয়ায় বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অল্প সুযোগই পেয়েছে সে তুলনায়। বাঙলা পত্রিকাটিতে অধিক মাইনের লোভে এমন কতিপয় লোক আয়ুব রাজত্বের শুরুর দিকে আত্মবিক্রয় করলেন, যারা সুন্দর বাঙলা লিখতে পারেন, সাংবাদিকতায় যাদের হাত পেকেছে, কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক এবং বামপন্থী রাজনীতি ঘেঁষা বলে যারা আগেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তরুণ অনতিপ্রবীণ, প্রবীণ সকলে আয়ুব খানের সামরিক গেজেটে যোগ দিয়ে একনায়কের জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। তার ফল হলো, তরুণ এবং কিশোরেরা কোনো রকমের সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হলেন। পত্রিকায় যে আকর্ষণীয় সাহিত্য বিভাগ চালু করা হয়েছিলো আসলে ওটা ছিলো সাহিত্যের কসাইখানা। কারণ সাহিত্যে জাতীয় অভাব অভিযোগের কথা, সামাজিক দুর্নীতির কথা আসা চাই-ই। কিন্তু দৈনিক পত্রিকাটি একটা পর্যায়ে বক্তব্যহীন কিন্তু রঙচঙে রচনাই ছাপতেন। দেশের অভাব অভিযোগের দিক থেকে তরুণদের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার জন্য এই মনোরম ফাঁদ পেতেছিলেন, তাতে করে ঐ পত্রিকার হোমড়া চোমড়া গোছের লোকেরা অপরাধ বোধ লাঘবের এক ধরণের আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন।