.
পাকিস্তান আমলের গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। পাকিস্তান হওয়ার পরপরই এদেশে একটা সাংস্কৃতিক ‘এলিট শ্রেণী সৃষ্টি হতে থাকে। দুনিয়ার বুকে পাকিস্তান একটা বিসংগত রাষ্ট্র-এই রাষ্ট্রের সরকারী দর্শনও বিসংগত। ইসলাম, মুসলিম জাতীয়তা, ইসলামী রাষ্ট্র এসব গালভরা মনোহর মিথ্যে বুলিই ছিলো পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত আদরের জিনিস। তারা এসব কপচাতেন এ কারণে নয় যে, সত্যি সত্যি এগুলোর প্রতি কোন মমতা ছিলো–কিংবা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন। রাষ্ট্রীয় দর্শন আওড়ালে, প্রশংসা করলে পয়সা পাওয়া যেতো। তাই তাঁরা দরাজ গলায় অমন একনিষ্ঠভাবে রাষ্টীয় দর্শনের গুণ বাখান করতেন। গল্প, উপন্যাস, কাব্য, ইতিহাস এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণী থেকে প্রাইমারী স্কুলের নিম্নতম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্ত ক পর্যন্ত তাদের পক্ষাঘাতদুষ্ট মনোভঙ্গীর অক্ষয় রাজত্ব। প্রতিবাদ করার কেউ ছিলো না। প্রতিবাদ করলে উপোষ করতে হতো, প্রতিবাদ করলে জেলে যেতে হতো। শুধুমাত্র রাষ্টীয় দর্শনকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্যে অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিদগ্ধ জন কতো আকাজ কুকাজ করেছেন একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। বাঙলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস লেখা হয়েছিলো এবং ইতিহাসটি ছাত্র ছাত্রীদের এখনো পড়ানো হয়। তাতে অনেক স্থলেই প্রকৃত ইতিহাসকে হত্যা করা হয়েছে। সবচে’ আশ্চর্যের হলো ইতিহাসকারদ্বয় জেনেশুনেই সত্যকে হত্যা করেছেন। বর্তমান সময়ে বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছে গ্রন্থকারদের থাকার কথা নয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তো বইটি পাঠ্য করার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকে ইসলামী রাষ্ট্র নামের ব্যঞ্জনায় কেউ মোহিত হয়ে, কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ প্রতিপত্তির কারণে, কেউ লোভে পড়ে, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটি পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলো। এই রকম একটা আবহাওয়া পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরা সৃষ্টি করেছিলো বলেই পশ্চিমারা অতো সহজে কোনো রকমের আগ পাছ চিন্তা না করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেবার দুঃসাহস করেছিলো। তার ফল অজানা নয় কারো । যা বিনা কথাতে পাওয়া উচিত, তার জন্য রক্ত দিতে হলো। শুরু থেকেই একটা জিনিশ পরিষ্কার আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশের জনসাধারণ ভুল করেননি এবং খুব কমই বিভ্রান্ত হয়েছেন। যখনই কোনো সরকারী সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থের এবং বাস্তব জীবন ধারার বিপক্ষে গেছে তারা কোমর বেঁধে পৌরুষের সাথে প্রতিবাদ করেছেন। জনগণের চিন্তাধারায় অগ্রসরমানতা এবং পরিচ্ছন্নতা দেয়ার মতো কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াস হয়নি বললেই চলে। এখানে একটা কথা বলে দেয়া প্রয়োজন। ভাষার প্রশ্নে আমাদের দেশের কোনো পণ্ডিত বাঙলা ভাষার স্বপক্ষে মতামত রেখেছিলেন, কিন্তু তা এত ক্ষীণ অস্পষ্ট এবং সংশয়াচ্ছন্ন যে, জনগণের মধ্যে তার খুব সামান্যই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সুতরাং যা ঘটবার ঘটে গেলো। ছাত্র তরুণেরা প্রাণ দিলো–দেশে আগুন জ্বলে উঠলো। আর কবি সাহিত্যিকেরা শোক সভায় সভাপতির আসন দখল করলেন প্রবন্ধে-কবিতায় এক কলসী করে অশ্রু বিসর্জন করলেন।
উনিশশো বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনের পর পর এ দেশের সংস্কৃতির একটা পট পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছিলো। এই সময়ে আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কতিপয় স্পর্ধিত তরুণের আবির্ভাব লক্ষ্য করি। তাদের দেখবার চোখ, চিন্তা করার ভঙ্গী, বিচার করার পদ্ধতি পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবী ও শিল্প সাহিত্যের মুরুব্বীদের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের জং ধরা খোলস প্রাণশক্তির তোড়ে ফাটিয়ে ফেলার যে স্পর্ধিত স্পৃহা তাদের মধ্যে দেখা গেছে তা প্রশংসা করার মতো। কিন্তু ঝিলিক দেয়াটাই সার। আজকের দিনে বাঙলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, তাদেরকে পরিণত চিন্তার অধিকারী এবং স্থিতধী দিকদ্রষ্টা হিসেবে দেখতে পাওয়াটা খুবই প্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু বাস্তবের সংঘাতে জাতির সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাঙলাদেশে সংস্কৃতির যে নতুন সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো, যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই তার গতিবেগ মন্দা হয়ে আসে। সে সুবাদে পাকিস্তানের প্রবক্তা বুদ্ধিজীবীরা, শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ তাদের টলটলায়মান আসনগুলোতে নড়েচড়ে শক্ত হয়ে জেঁকে বসেন। গোটা বাঙলাদেশে তারা অর্ধ বর্বরসুলভ চিন্তাচেতনা চাপিয়ে দিতে থাকলেন। এ ব্যাপারে সে সময়কার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়ী না করে উপায় নেই। রাজনীতির উত্থান-পতনে, জয়পরাজয়ে সংস্কৃতির যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আদপেই সে ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিলো মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ কর্মীদের সাংস্কৃতিক চেতনাহীনতা, ইতিহাস ভূগোলের জ্ঞানের অভাবের দরুণ তারা নেতৃমোহে তাড়িত হয়েছেন এবং নেতারা ডন কুইকসোটে পরিণত হয়েছিলেন। একটি সমাজে সর্বাঙ্গীন গতির নাম রাজনীতি এবং সংস্কৃতি রাজনীতির রস রক্ত, এই বোধে কোন রাজনৈতিক দল কিংবা লোকমান্য নেতার মন সিঞ্চিত হয়েছে, তেমন কোন দল বা ব্যক্তিত্বের নাম আজো জানা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি বিমুখতা, কর্মীদের চেতনাহীনতা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে দুটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করলো । ফরাসী লেখক আলফাস দোঁদের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ফরাসীরা যুদ্ধে মার খেয়েছে, গল্পের নায়ক খুবই আশাহত হয়ে পড়েছে, আরেকজন তাকে উপদেশ দিচ্ছে ফরাসী সাহিত্য পড়ার। তার মানে ফরাসী সাহিত্যের মধ্যে এমন কিছু প্রাণদায়িনী উপকরণ রয়েছে, যার প্রভাবে নায়ক যুদ্ধে পরাজয়ের হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারবে। পুরোপুরি না হোক,