একটা সমাজের একটা বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাহ্নে বুদ্ধিজীবীদের কি ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত? বাঙলাদেশের আজকের যারা নামকরা বুদ্ধিজীবী, তারা কি আদৌ তাদের ভূমিকা পালন করেছিলেন? প্রমাণ হাতের কাছেই রয়েছে। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু পোষাকী ভূমিকা পালন করেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর হামলা, বর্ণমালা সংস্কার প্রচেষ্টার প্রশ্নে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এককাট্টা হয়ে সামরিক সরকারের আরোপিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। এটা একদিক-এ দিকটাকে আমরা পোষাকী বলেছি। কারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতো অধিক হারে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের চুপ করে থাকার কোন উপায় ছিলো না। তারা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু প্রতিবাদ করার কারণে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকে চাকুরী হারাতে হয়েছে অথবা জেলে যেতে হয়েছে এমন কোনো মানুষের নাম আজও জানার সৌভাগ্য হয়নি। অথচ শিল্প, সংস্কৃতি এবং সমাজের এমন অনেক গভীর, বিকট হাঁ করা প্রশ্ন ছিলো, যে সকল বিষয়ে একজন কি দু’জন ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠাবান বুদ্ধিজীবীই উচ্চবাচ্য করেননি। কেন এমন হলো; জবাবে সেই প্রথম কথাই এসে পড়ে। বুদ্ধিজীবীরা সুবিধাবাদী, ঝড়-ঝঞ্জা, বিপদ-আপদ এড়িয়ে চলাই স্বভাব । তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্যে দোষ দিয়ে লাভ নেই । সচরাচর এমনই হয়ে থাকে।
সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি রকম ছিলো? খুব বেশি কথা নয় স্মৃতিতে এখনো তাজা রয়েছে। সামরিক সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার কালো থলিতে পুরেছে, প্রতিদিন ধর পাকড় চলেছে, প্রতি মাসে গুলি চলেছে, প্রতি বছরেই জনগণের রুদ্ররোষ উথলে উথলে উঠেছে। এ সবের মধ্যে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কোন জাতীয় সম্ভাবনা আঁচ করতে পারেন নি। বাঙলাদেশ যে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দু’যুগ, এক যুগ, ছ’যুগ, দু’বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোনো বইতে বাঙলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তার ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে।
বাঙলাদেশের জনগণই বাঙলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ঘটনা ঘটেছে ঘটনার নিয়মে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তার কোনো তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া হয়নি। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের দানই নগণ্য। বলতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের সচেতন দিক নির্দেশনা ব্যতিরেকেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে একটা কথা আছে না, বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে তা আরো একবার সত্যে পরিণত হয়েছে। আসল ঘটনা ঘটে যাবার পর সকলে আপনাপন গর্ত থেকে শেয়ালের মতো বেরিয়ে সমস্বরে জয়ধ্বনি তুলছেন। চিন্তাশীলতার লক্ষণই তো হলো সমাজের নানামুখী স্রোতের গতিধারা অনুধাবন করে একটা সামঞ্জস্য বিধান করার প্রচেষ্টা। বাঙ্গালী জনগণের চেতনার ঘনত্ব অনুধাবন করতে বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবৃন্দ কি সত্যি সত্যি অক্ষম ছিলেন? যদি তা না হয় গোটা বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এমন একটি অভূতপূর্ব ঘটনা অনতিবিলম্বে ঘটতে যাচ্ছে, অন্ততঃ তার জলছবিটিও কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াসের মধ্যে ছায়াপাত করলো না কেনো? ঘটনা ঘটলে তারপর চিন্তা করতে বসবে–সকলের ক্ষেত্রে এ কেমন করে সত্য হয়? আমাদের দেশে আগাম চিন্তা করতে পারে এমন কোন মানুষ কি ছিলোই না? সংস্কৃতি বাস্তব রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে থাকেথ-তা কি আমাদের দেশে মিথ্যে হয়ে গেলো?
এই সকল বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। কেননা, চিন্তা কাজের সূক্ষ শরীর। আমাদের সমাজ একটি পরিবর্তনের মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে। সমাজের খোল নলচে দুই-ই বদলে নতুন সমাজ সৃজন করার জোরালো দাবী সমাজের মর্মমূল থেকেই তীব্রবেগে স্কুরিত হয়েছে। এই সৃজন প্রক্রিয়াতে বেগ এবং পূর্ণাঙ্গতা দান করতে হলে, রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাত্রেও প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বাঙলাদেশের মানুষ সমৃদ্ধিশালী, সুখী একটি মানব সমাজ, একটি তৃপ্তি ধারার সভ্যতা নির্মান একটি বলবন্ত ফলবন্ত সংস্কৃতির অধিকারী হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । এই নতুন সমাজের দুটি দিক। এক রাজনীতি, দুই সংস্কৃতি। একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের থেকে চলার পথের গতি এবং প্রাণরস আহরণ করে। রাজনীতিতে যেমন, তেমনি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রথম ধাপ হলো অতীতের সংস্কৃতি প্রবাহ বিচার বিশ্লেষণ করে তার হাঁ ও না’এর দিক চিহ্নিত করা এবং প্রাণের ইশারাটুকুতে গতিময়তা দান করা।
বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অতীতে তাদের সামাজিক ভূমিকা যথাযথ পালন করতে পারেননি। একথা সত্যি। সেজন্য তাদের এক তরফা দোষারোপ করলে কোনো লাভ হওয়ার কথা নয়। কোনো সমাজে কোনো বিশেষ ব্যক্তি যদি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার জন্য সে ব্যক্তি এবং সে সমাজ উভয়েই দায়ী। কারণ, ধরে নিতে হবে সে সমাজের এমন কোনো ক্ষমতা নেই, যার বলে ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে পারে অথবা ব্যক্তির মনে এমন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে অপারগ, যার ফলে ব্যক্তি আপনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রাক-স্বাধীনতা কালে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন নিতা অত্যন্ত নিন্দনীয়; কিন্তু কেন পারেননি, কারণগুলো নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে ।