কিন্তু একটি জিনিশ এখানে উল্লেখ না করলে এই ভূমিকা বহুলাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কথাটি হলোঃ মধ্যশ্রেণীভূক্ত হোমরা-চোমরা ব্যক্তিদের এবং তরুণ ও ছাত্র সম্প্রদায়ের এক ব্যাপক অংশের উপরোক্ত চরিত্র লক্ষণসমূহকে একেবারে সার্বজনীন মনে করা আজকের এই বাঙলাদেশেও অসঙ্গত। আমরা জানি আমাদের দেশের হাজার হাজার মধ্যশ্রেণীভূক্ত যুবক ও ছাত্র কিভাবে স্বদেশকে ভালবেসে, স্বদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারকে অর্জন ও সমুন্নত রাখার জন্যে সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত থেকেছেন, প্রয়োজনে তা বিসর্জন দিয়েছেন। একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তারা নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি। মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই তরুণদের মধ্যে আজ অনেকেই নতুনভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে সংগঠিত করার কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে উন্মুখ । অনেকে একাজে ইতিমধ্যেই নিযুক্ত। যে কোন দেশেই বিপ্লবের প্রাথমিক স্তরে শ্রমিক কৃষকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনাকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । শুধু তাই নয়। এঁদের এই প্রাথমিক ভূমিকা ব্যতীত কোন দেশে আজ পর্যন্ত কোন বিপ্লব উপযুক্তভাবে সংগঠিত ও সফল হয় নি।
বাঙলাদেশে আজ সাহিত্য ও কাব্যচর্চা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ওপর তলায় সুবিধাবাদের যে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে সেটা ওপর তলারই ব্যাপার। সামগ্রিক বিচারে তার গুরুত্ব তেমন বেশি নয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের তুফানে এই সমস্ত সংস্কৃতি সেবীরা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও খড় কুটোর মতো উড়ে যাবে। তাই আজ ওপর তলার এই সমস্ত ভাড়াখাটা সংস্কৃতি সেবীদের সমালোচনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সমালোচনা এবং সংস্কৃতি চর্চার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে, যে সমস্ত নূতন ও তরুণরা সম্পত্তি সংগ্রহের ঝোঁক অতিক্রম করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে সংস্কৃতি চর্চা করতে, রাজনীতি সংগঠিত করতে এগিয়ে আসছেন তাঁদের সহায়তা করা। তাঁদের উম্মেষ ও কর্মক্ষেত্রকে সাহায্য ও প্রসারিত করা ।
আহমদ ছফাও তাঁর এই সংকলনটির শেষে এই ধরনেরই একটা কথা বলেছেন। আশা করা যায় তিনি তার ভবিষ্যৎ রচনা সমূহের মধ্যে শ্রেণীভূক্ত প্রগতিশীল লেখকদের কর্মকাণ্ডের প্রতিই নিজের দৃষ্টিকে অধিকতরো নিবন্ধ রাখবেন।
বদরুদ্দীন উমর
৩/১২/৭২
.
লেখকের কথা
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এতো অন্যায়, অবিচার এতো মূঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে। এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলেনা। এই স্বল্প পরিসর গ্রন্থে যা বলেছি সব আমার কথা নয়। হামেশাই যা আলোচিত হতে শুনেছি তাই-ই একটু জোর দিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে বলবার চেষ্টা করেছি। তাও সবসময় পেরেছি তেমন দাবী করতে পারবো না। সৎসাহসকে অনেকে জ্যাঠামী এবং হঠকারিতা বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু আমি মনে করি সৎসাহস হলো অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা যথাযথভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের যাবতীয় তত্ত্ব এবং তথ্য আমি কোথাও না কোথাও থেকে আহরণ করেছি, কেবল উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করার সাহসটুকুই আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। দৈনিক গণকণ্ঠে যখন লেখাটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিলো অনেকে প্রশংসা করেছেন, অনেকে নিন্দা করেছেন! নিন্দা প্রশংসার প্রত্যক্ষ কারণ বলে যা মনে করি, অসংকোচে আমাদের সংস্কৃতির কতিপয় প্রখ্যাত অমানুষের নাম সাকিন উল্লেখ করতে পেরেছিলাম। কুৎসার প্রতি মানব সাধারণের মমতা তো সুবিদিত। বই আকারে বের করার সময় নামগুলো ছেটে দিলাম। সুযোগ সন্ধানীরা অল্প বিস্তর চিরকাল থাকে। মোটাবুদ্ধি, ভোঁতা অনুভূতি, পুরো চামড়াই তাদের টিকে থাকার মূলধন। তার বাইরেও দেশের মানুষের হয়ে, অকৃত্রিমভাবে কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করেছি। কবি আল-মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে যত্ন নিয়ে লেখাটা দৈনিক ‘গণকণ্ঠে’র জন্য আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন, তার কাছে এবং ‘গণকণ্ঠে’র বন্ধুদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ । শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর সদয় হয়ে ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বইটি বের করতে হয়েছে এবং আমি একেবারে আনাড়ি প্রুফ রিডার বলে অনেকগুলো মারাত্মক মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেলো।
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস
বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাঙলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।
আগে বৃদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়-প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালী হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাঙলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা সারা জীবন কোনো কিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন-সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।
মামুলীভাবে বলা হয়ে থাকে, বুদ্ধিজীবীরা তো সুবিধাবাদীই। সুতরাং তাদের কোন কর্ম নিয়ে হৈ চৈ করা পণ্ডশ্রম। সুবিধাবাদই বুদ্ধিজীবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কথাটা যদি সর্বাংশে সত্য হয়ে থাকে, তা হলে ধরে নিতে হবে সমাজে ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, সত্যি-মিথ্যে উচিত-অনুচিতের মধ্যে কোনোও প্রভেদ নেই।