আহমদ ছফা
১৫ আগস্ট ১৯৯৭
উত্থানপর্ব কার্যালয়
ইহা, ৭১ আজিজ সুপার মার্কেট
শাহাবাগ, ঢাকা-১০০০।
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এর লেখক আহমদ ছফা বাঙলাদেশের মধ্য শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের কতকগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁদের বিশিষ্ট মানসিকতার বিবর্তনের ধারা এই প্রবন্ধ সংকলনটিতে কিছুটা আলোচনা করেছেন। এই আলোচনাকে মূলতঃ বাঙলাদেশের মধ্য শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদেরই একজনের স্বশ্রেণীর বিরুদ্ধে একটা নিঃশঙ্ক সমালোচনা বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদের একটা ঝোঁক যে তাঁদের একটা শ্ৰেণীগত বৈশিষ্ট্য এ বিষয়ে এই তরুণ লেখকের যে কিছুমাত্র সংশয় নেই সেটা তাঁর লেখায় প্রতিটি ছত্রে সুস্পষ্ট, কিন্তু তবু তিনি স্বদেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক সুবিধাবাদিতায় নিদারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। তার এই বিক্ষোভের কারণ একদিকে মধ্যশ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে সুবিধাবাদের সাধারণ আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি এবং অনেক ক্ষেত্রে আংশিকভাবে সুবিধাবাদ উত্তীর্ণ হতে সক্ষম, এই ধারণার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা এবং অন্যদিকে বাঙলাদেশের এই শ্ৰেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাস্তব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে একটা সামগ্রিক ও দিগন্তপ্রসারী সুবিধাবাদের অবাধ রাজত্ব। বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ সুবিধাবাদের পাশাপাশি তাদের একাংশের সুবিধাবাদ উত্তীর্ণতার যে সন্ধান তিনি করেছেন সেই সন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার মধ্যে তার বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ মন্তব্যের মর্মকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং সে চেষ্টা করলে বর্তমান বাঙলাদেশে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন মধ্যশ্রেণীভূক্ত জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত করছে তারও কতকগুলো মূলসূত্রের সন্ধান এ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে পাওয়া যাবে।
বাঙলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আহমদ ছফা শ্রেণী বিশ্লেষণের কোনো চেষ্টা করেননি। কিন্তু দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোত যোগসূত্রে আবদ্ধ একথা তিনি স্বীকার করেছেন। এবং এই স্বীকৃতির ওপরই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাথমিক ভিত্তি। কোন লেখক যদি নিশ্চল সততা এবং নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায়কে অবলম্বন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সাথে সাংস্কৃতিক জীবন এবং সংস্কৃতি চর্চার যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন তাহলে সংস্কৃতি চর্চাকে তিনি শেষ পর্যন্ত একটা শ্রেণীগত কর্মকাণ্ড বলে সিদ্ধান্ত করতে দ্বিধাবোধ করবেন না এবং নিজের বিশ্লেষণকে আরও সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে আলোচনাকে সামগ্রিকভাবে শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর দাঁড় করাবেন । আহমদ ছফা এই সংকলনের প্রবন্ধগুলিতে আলোচিত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে যেহেতু মোটামুটিভাবে সঠিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়েছেন সেজন্য এটা আশা করা অবাস্তব হবে না যে ভবিষ্যতে তিনি তার সমালোচনার ক্ষেত্রে শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করবেন।
বর্তমান বাঙলাদেশের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষতঃ ‘লব্ধ-প্রতিষ্ঠ’ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে নির্লজ্জতা, ভণ্ডামী, কাপুরুষতা এবং সুবিধাবাদ আজ দোর্দণ্ডপ্রতাপ তা শুধু বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। এই প্রবণতা বস্তুত পক্ষে রাজনৈতিক জীবন থেকে রস সংগ্রহ করেই আজ দিকে দিকে অংকুর থেকে পরিণত হচ্ছে মহীরুহে। তথাকথিত সংস্কৃতি চর্চার নামে যে কদর্য বেহায়াপনা, এবং আত্মসেবা এদেশের ‘লব্ধপ্রতিষ্ঠ’ বুদ্ধিজীবীরা আজ করে চলছেন সে বেহায়াপনা এবং আত্মসেবা রাজনীতিবিদদের বেহায়াপনা এবং আত্মসেবার সাথে অবিচ্ছিন্ন। সামগ্রিকভাবে এদেশের সাম্রাজ্যবাদকবলিত বুর্জোয়াশ্রেণী আজ যে শাসন ও শোষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনস্বার্থ পদদলিত করে নিজেদের শ্ৰেণীস্বার্থ পুষ্ট করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তারই একটা সুস্পষ্ট চিত্র মধ্যশ্রেণীভুক্ত এই বুদ্ধিজীবীদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে পাওয়া যায়।
লেনিন বলেছেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে যারা শ্ৰেণীনিরপেক্ষ বলে কলাকৈবল্যবাদ প্রচার করে তারা নির্মম ভণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই যারা এক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদের কথা বলে তারা আসলে শোষকশ্রেণীর সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের কাব্যচর্চা ইত্যাদির সঠিক শ্রেণীচরিত্রকে শোষিতশ্রেণীর চোখের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই তা বলে থাকে। কিন্তু তবু কোন ক্ষেত্রে আমরা দেখি শোষকশ্রেণীভূক্ত এই সমস্ত সংস্কৃতিসেবীদেরকে নিজেদের মুখোস অনেকখানি ছিঁড়ে ফেলতে, নির্লজ্জ এবং নগ্নভাবে শাসকশ্রেণী অর্থাৎ তাদের নিজেদেরই শ্রেণীর বড়ো তরফের ভাড়া খাটতে। আমাদের দেশেও আমরা পাকিস্তানী আমলে, বিশেষতঃ সামরিক শাসনের আমলে, তা দেখেছি। অনেকে ভেবেছিলেন যে, পূর্ব বাঙলায় একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু তাদের সে আশা ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা উদ্ভূত বিক্ষোভই আহমদ ছফার প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রে এই ভাড়াখাটা সংস্কৃতিসেবীদের স্বদেশ প্রেম ও আত্মপ্রেম ন্যাক্কারজনকভাবে একাকার হতে দেখে তিনি অনেকখানি উত্তেজিত হয়েই এই সংকলনে স্থানপ্রাপ্ত প্রবন্ধগুলি রচনা করেছেন।