.
০২.
এই লেখার শুরুতেই জানিয়েছি ‘বুদ্ধিবৃত্তির নুতন বিন্যাস’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশো বাহাত্তর সালে। এখন সাতানব্বই। মাঝখানে সিকি শতাব্দীর ব্যাবধান। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কোনো রকমের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া লেখা একটি রচনা এই পঁচিশ বছর পরেও কতোটা প্রসঙ্গিক হতে পারে, বইটি পাঠ করতে গিয়ে নতুন করে টের পেলাম । বিশ্বাসই হতে চায় না যে রচনাটি আমি লিখেছিলাম। এই গ্রন্থে যে সকল মতামত প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো বাহাত্তর সালে যতোটা প্রাসঙ্গিক এবং সত্য ছিলো, এই সাতানব্বই সালে তাদের তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ না হয়ে বরং অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুখ্যতঃ সে কারণেই নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশের প্রক্কালে নতুন একটি ভুমিকা লেখার প্রয়োজন অস্বীকার করতে পারিনি।
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে জাতীয় মধ্যেশ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রীয় চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলেছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে তোষামোদ, চাটুকারিতা, নিলজ্জ আত্মপ্রচার মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানকে এক রকম মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলো । সন্ত্রাস, গুম, খুন, ছিনতাই, দস্যুতা, মুনাফাখখারি, কালোবাজারী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচার হত্যা এগুলো একান্তই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো । মানুষের হনন প্রবত্তি, লোভ রিরংসার এরকম নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের সিংহ দুয়ার খুলে দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। এই ধরনের একটি মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই একটি পালনীয় ভূমিকা ছিলো, একটা দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু তারা সেদিন তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে যাবতীয় অমানবিক কর্মকাণ্ডে সরকারের মদদ দিয়ে নিজেদের আখের গুছাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সামগ্রীক পরিস্থিতির এরকম অবনতির বহুবিধ গভীরতরো কারণ নিশ্চয়ই বর্তমান ছিলো এবং সেগুলোর উৎসও ছিলো জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। আমি চারদিকে যা ঘটছে খোলা চোখে দেখে প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত হয়ে আমার শঙ্কা, সন্দেহ এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তি ছাপার হরফে প্রকাশ করেছিলাম। আমি যা লিখেছিলাম, তার একটা বাক্যও আমাকে গবেষণা করে আবিষ্কার করতে হয়নি। আমার চারপাশে যা ঘটছে দেখে, চারপাশের মানুষের মুখের কথা শুনে আমার বয়ানটুকু তৈরি করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো এ অবস্থা চলতে পারে না, এই মিথ্যার পাহাড় এক সময়ে ধ্বসে পড়তে বাধ্য। আমি এই বইটিতে যে সকল সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, তার প্রতিটি বাক্য অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ পরিহার করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা আরোপ করলেন এবং সর্বময় ক্ষমতার কর্তা হয়ে বসলেন। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চারটি প্রতীতিকে জাতীয় মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করলেন বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেগুলো একদলীয়, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এক ব্যক্তির শাসন ত্ৰাসনের হাতিয়ারে পরিণত হলো। তার মর্মান্তিক পরিণতি এই হলো যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত হতে হলো। রাষ্ট্রক্ষমতা বেসামরিক একনায়কের হাত থেকে সামরিক একনায়কের হাতে হস্তান্তরিত হলো। একের পর এক সমর নায়কেরা সমাজের পাতাল প্রদেশ থেকে পশ্চাদপদ ধ্যান ধারণা, ধর্মান্ধতা শুধু জাগিয়ে তুলে ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর আইনগত স্বীকৃতি দান করে আমাদের জাতীয় জীবনের গন্তব্য অধিকতরো ধোয়াটে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছেন। স্বাধীনতার শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা একজোট হয়ে শেখ মুজিবের অগণতান্ত্রিক একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে যদি রুখে দাঁড়াতেন তাহলে আমাদের জাতিকে এতোটা পথ পশ্চাত প্রত্যাবর্তন করতে হতো না। যে কোনো দেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসম্মত হন সেই দেশটির দুর্দশার অন্ত থাকে না। বাংলাদেশ সেই রকম একটি দুর্দশাগ্রস্থ দেশ। এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উদ্যোগ, কোনো প্রয়াস কোথাও পরিদৃশ্যমান নয়।
বর্তমানে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকাটি পালন করছে, তা কিছুতেই বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে আওয়ামী বাকশালী বুদ্ধিজীবীরা যে কাপুরুষোচিত ভূমিকা পালন করছে, তার চাইতে বেশী আলাদা নয়। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় বাহাত্তর তেয়াত্তর সাল থেকে টাইম মেশিনে চড়ে তাঁরা এই সাতানব্বই সালে পদার্পণ করেছেন। বাহাত্তর সালে তারা যেভাবে যে ভাষায় অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতেন বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করতেন; এই সাতানব্বই সালেও তাঁরা একই ভাষায় সেই পুরোনো বুলি গুলো উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে তাঁদের কণ্ঠস্বর এখন অধিকতরো দ্বিধা এবং জড়িমাহীন। অনেকটা স্বৈরাচারী অবস্থানে দাঁড়িয়ে তাঁরা এই প্রত্যয়সমূহ উচ্চরণ করে যাচ্ছেন। সাজানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইনেভোগী নটনটীর মতো সেই পুরোনো কথা বলে যাচ্ছেন তাদের কণ্ঠস্বর থেকে অভব কিংবা উপলব্ধির কোনো তড়িৎ সঞ্চারিত হয় না। তাঁদের উচ্চারণ থেকে কোনো গাঢ় প্রত্যয়ের দীপ্তি জনমানসে বিকীরিত হয় না।