.
০৮.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রসত্তাকে ঘিরে যে সকল বিতর্ক জন্ম নিয়েছে, আসলে সেগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই উত্তরাধিকার। অর্থাৎ হিন্দু মুসলমান এবং অপরাপর জাতি মিলে একটি জাতি না দুটি জাতি না অনেক জাতি। বৃটিশ ভারতে এ সমস্যাটার সমাধান হয়নি, তাই ভারতকে দু’টুকরো করতে হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে জাতীয়তার সংকটটির নিরসন হয়নি বলেই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি করতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও সেই মৌলিক সংকটটি নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে জাতীয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ বিশেষ সময় আসে, যখন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তার প্রশ্নে বিভাজন রেখাগুলো বড়ো বড়ো ফাটলের জন্ম দেয়। বাংলদেশ রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটাকে বলা যাবে না। কিন্তু একথা তো সত্যি একটা শেকলের জোর কতো তার দুর্বল কড়াটির প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যেই প্রমাণ মিলে ।
ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কী দেখতে পাই? বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে সমস্ত ভারতীয়রা মিলে একটা জাতি, তার ভিত্তিতেই ভারতীয় ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়েছিলো। সেই জায়গাটিতে ভারত কি স্থির থাকতে পারছে? বিকাশমান জাতীয়তার ধারণাগুলো ভারত অস্বীকার করতে পারছে না, নতুন নতুন জাতীয়তার ধারণাগুলোর সঙ্গে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর সংঘাত লেগেই আছে। খুব শ্লথগতিতে হলেও ভারতকে এই বহু জাতীয়তার অভিমুখে অগ্রসর হতে হচ্ছে। ভারতে যে ব্যাপারটি বিবর্তন, রূপান্তর এবং ক্রমাগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটছে, সেই একই জিনিস পাকিস্তানে আচমকা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঘটে গেছে। এই ঘটনার সঙ্গে সীজারিয়ান অপারেশনের তুলনা করা যায়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে পাকিস্তান মুসলিম লীগেরই ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জন্ম নিয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তার চিন্তা-চেতনায় অনেক নতুন মৌল উপাদানের সংযোজন হয়েছে। কিন্তু তারপরেও একটা জিজ্ঞাসা এখানে প্রধান হয়ে দেখা দেয়। যে সামাজিক শক্তিগুলো ভারত রাষ্ট্রকে এক জাতীয়তার মধ্যে বহু জাতীয় অবস্থানের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সেই সামাজিক শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে কিনা। উত্তর হবে খুব সম্ভবতো ‘না’। বামপন্থী আন্দোলনের সার্বিক উত্থানই বাংলাদেশের বিবাদমান সম্প্রদায়, জাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব, সংঘাত কমিয়ে আনতে সক্ষম। মনে রাখা প্রয়োজন শোষিত শ্ৰেণীগুলোর নেতৃত্বে রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সংবিধানে পঞ্চাশ পাতা লিখেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জাতিগুলোর অধিকার দেয়া যাবে না। বামপন্থী রাজনীতির সার্বিক উত্থান ছাড়া এই দেশটির মুক্তি সম্ভব নয়। বামপন্থী আন্দোলনের বিকাশের ধারাটি পর্যালোচনা করে যে সকল বাঁকে বিভক্তি, বিভ্রান্তি, বিচ্যুতি আন্দোলনের গতিবেগকে দুর্বল করেছে, ভুল পথে পরিচালিত করেছে, ঠাণ্ডা মাথায় সেগুলো চিহ্নিত করে বামপন্থার বিকাশের নতুন সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
যেসকল কারণে বামপন্থী রাজনীতি এদেশের প্রধান রাজনৈতিক ধারা হয়ে উঠতে পারে নি সেগুলোরও একটা খতিয়ান করা প্রয়োজন। প্রথমতঃ জাতিসত্তার প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে বামপন্থী রাজনীতি বিপ্লবের প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলো এবং তাই-বামপন্থী রাজনীতি জাতীয় নেতৃত্বে অবস্থান হারিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতাদর্শগত দ্বন্দ্বটি আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলো যতোটা বড়ো করে দেখেছে, আমাদের দেশের শোষিত জনগণের প্রশ্নটি তাঁদের চোখে সে তুলনায় গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা মৌলিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংযোগ সাধন করে পরিবর্তনকামী শক্তিগুলো একটা জঙ্গী ঐক্যমোর্চায় টেনে আনার ব্যাপারে তারা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। চতুর্থতঃ আমাদের শোষিত জনগণের সামগ্রিক স্বার্থটির প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কনিষ্ঠ অংশীদার হওয়ার প্রবণতা জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অসম্ভব করে তুলেছে। পঞ্চমতঃ মেহনতি জনগণের সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে তাদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা সামন্ত সংস্কৃতির রিক্তাবশেষকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ সাহায্য করেছে, যা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগীতায় বারবার আমাদের সংস্কৃতির গতিধারার সুষ্ঠু বিকাশ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। ষষ্ঠতঃ। বৃহত্তরো জনগোষ্ঠীর মানস চৈতন্যের শুশ্রূষা করে তার মান উন্নত এবং বোধ উপলব্ধিতে নতুন সমাজের ভ্রণ গ্রহণ করার পরিবেশ সৃষ্টি না করে অনুভূতিকে আহত করার প্রবণতা বৃহত্তরো জনগণকে বামপন্থার প্রতি বিমুখ করে তুলেছে। সপ্তমতঃ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জাতিসমূহের নিরাপত্তা এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারের প্রতি যথেষ্ট অঙ্গীকারসম্পন্ন না হওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জন্ম দিয়েছে। অষ্টমতঃ বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দ সমস্ত জাতির নেতৃত্ব দেয়ার বদলে সমাজে বিশেষ বিশেষ অংশকেই কর্মক্ষেত্র মনে করেন বলে তারা একটি পলায়নবাদী, পরাজিত মানসিকতার শিকারে পরিণত হয়েছেন। সে কারণে বামপন্থী রাজনীতিকে আমাদের রাজনীতির প্রধান ধারা হিসেবে তারা চিন্তা করতেও সক্ষম নন। নবমতঃ বিশ্বপরিসরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতন আদর্শিকভাবে আমাদের বামপন্থী দলগুলোর নেতা এবং কর্মীদের হতবিহ্বল হরে ফেলেছে। তাই তারা আমাদের শোষিত জনগণের উত্থান ক্ষমতার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারেন না। দশমতঃ বাজার অর্থনীতির জয়যাত্রা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। তারা জনগণের শ্রমনির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের পথ পরিহার করে বাজারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করছেন। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক নয়। বিকল্প অর্থনৈতিক যুক্তি নির্মাণে বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফএ সকল আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ধনী দেশগুলোর স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতটি তারা উপেক্ষা করে থাকেন। একাদশতম কারণ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের জনউদ্যোগ এবং সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করার বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এ পর্যায়ে হয়তো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ যেভাবে সরকারের উত্থানপতনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে, তাদের এ ক্ষতিকারক ভূমিকার বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। তারাই বামপন্থার বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে।