সেই সময়ে মওলানা ভাসানীর ছত্রচ্ছায়ায় বেইজিংপন্থী রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছিলো। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলো বলে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা আদর্শগত কারণে চীনের প্রতি অনুগত ছিলেন। চীনের নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের বিরোধিতা করলে পাকিস্তানের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্থ হবে। সুতরাং চীনপন্থীদের মধ্যে আয়ুবের বিরোধিতা না করার একটা মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। বরঞ্চ তারা শেখ মুজিবের ছয় দফার বিরোধিতা করতে আরম্ভ করেন এবং ছয়দফার মধ্যে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে যান।
মস্কো এবং বেইজিংপন্থী রাজনৈতিক দল দুটো যখন পারস্পরিক বাদবিসংবাদে মত্ত সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার প্রতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি মধ্যবিত্ত সমর্থন দিয়ে বসে আছে। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র ছয় দফার সমর্থনে প্রবল গণজোয়ারের সৃষ্টি হলো। বাঙালী জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা যখন আওয়ামী লীগের কাছে দাবী জানালেন যে আন্দোলনে তাঁদেরও অংশীদার করা হোক, শেখ সাহেব এক বাক্যে জানিয়ে দিলেন, দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে চলে আসুন। বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে উত্তাল উত্থান পঁয়ষট্টি পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে জেগে উঠেছিলো বামপন্থী রাজনীতি তার নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ পড়ে গেলো । অথচ এটা অবিসংবাদিত সত্য যে বাঙালী জাতীয়তার বিকাশের প্রাথমিক সোপানগুলো, বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন।
নকশাল বাড়ি আন্দোলনের স্থপতি কমরেড চারু মজুমদার পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট রাজনীতিতে একটা নতুন চমক সৃষ্টি করলেন। তাঁর শ্ৰেণীশত্রু খতমের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী রাজনীতির একাংশকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। আবদুল হক এবং মোহম্মদ তোঁয়াহা, মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একটা দল তৈরি করেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর দখলদারিত্বের সময়ে কমরেড আবদুল হক পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোঁয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার হকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমান প্রমূর্খ উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের সময়েই চীনপন্থী রাজনীতির ভেতর থেকে সুদক্ষ সংগঠক সিরাজ শিকদারের আবির্ভাব। তিনি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করার দাবীতে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দান করেন। সিরাজ শিকদারের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাটি কিছুকাল সক্রিয় ছিলো। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওই ধারাটির অবসান রচিত হয়। রণো এবং মেননের অনুসারীরা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নরসিংদীর গ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন। সংক্ষেপে এই-ই হলো চীনপন্থী রাজনীতির অনুসারীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অবস্থানগত একটা খতিয়ান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া একটা মস্তবড়ো সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো। মুখ্যতঃ রাশিয়ার চাপের কারণেই বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র স্থান দখল করে নিতে পেরেছিলো। সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন ও কৃষক সংগঠন মিলিয়ে সমাজে তাদের একটা বড়ো রকমের অবস্থান ছিলো। তারা যদি ইচ্ছা করতেন, বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে কোনো বাধা ছিলো না। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার নির্দেশে তাদের এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে হলো। এই ঘটনাটি তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উভয়কে এমন একটা অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করে, সেখান থেকে অদ্যাবধি কারো পুরোপুরি উঠে আসা সম্ভব হয়নি। সেদিন যদি কোনো রকমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি চালু রাখা যেতো, বাংলাদেশে একের পর এক স্বৈরশাসন জন্ম নিতে পারতো না। দৃশ্যতঃ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করা হলেও দেশটিকে বিগত দিনের দায়ভাগ অদ্যাবধি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
বাম রাজনীতির সর্বশেষ তরঙ্গটি জেগে উঠেছিলো আওয়ামী লীগ সংগঠনটিরই ভেতর থেকে। আওয়ামী লীগের নিরাপোষ লড়াকু তরুণ যারা আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনোরকম আপোষ করতে দেয়নি, স্বাধীনতার পর তারাই আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাসদ গঠন করে। জাসদ দলটিকে বামধারার রাজনীতির সঙ্গে এক করে দেখা বোধকরি ঠিক হবে না। আওয়ামী তরুণ র্যাডিক্যাল অংশ থেকেই জাসদের সৃষ্টি। বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী উচ্চারণ করলেও অধিকসংখ্যক তরুণের তারুণ্যই ছিলো তাদের প্রাণশক্তি। দলটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলো বলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই ছিলো তার প্রবল ক্ষোভ। আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসার উগ্র আকাঙ্ক্ষার কারণে কোনো সুচিন্তিত রাজনৈতিক দর্শন দলটির চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। একের পর এক আত্মঘাতী উদ্যমের মধ্যে দলটি শক্তি ক্ষয় করতে থাকে। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসন যখন চেপে বসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা এবং কর্মীর মধ্যে একের পর এক বিভ্রান্তি জন্ম নিতে আরম্ভ করে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর দেড় দশকের মধ্যেই দলটি অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাসদের অপমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতির সব চাইতে করুণ সংবাদ। এই দলটির ছত্রখান হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি যুগের একটি প্রজন্মের বিপ্লবী আকাক্ষার অবসান ঘটে।