বামপন্থী রাজনীতির এই দৈন্যদশা সমস্ত দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিকামী মানুষের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটা সময় ছিলো, যখন বামপন্থী রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সকলের সামনে পরিদৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো। সকলে বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যতের মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ দেখতেন। এখন তাদের অতীত দিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জের হাজার হাজার কর্মী যারা দেশ এবং জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য সব রকমের আত্মত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হননি। এই সমস্ত ত্যাগী এবং নিষ্কলঙ্ক কর্মীরা এখন সকলের করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। রাজনীতি, কালোবাজারী, লুঠেরা, চোরাচালানি-এক কথায় সমাজের যতো খারাপ মানুষ আছে, তাঁদের স্থায়ী পেশায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতিতে সৎ মানুষের অবস্থান বহুকাল পূর্বেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, চিহ্নিত অপরাধী, মাফিয়াচক্রের হাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বন্দী হয়ে আছে। এই অবস্থাটি যদি দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকে, এই সমাজ মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য দেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের একটি রাজনৈতিক উত্থান অবশ্যম্ভাবী। পরিতাপের বিষয় হলো কৃষক, শ্রমিক, বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের সঙ্কট পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। অথচ তাদের প্রতিবাদ করার কোনো উপায় নেই। তাদের দাবীর কাছে শোষকশ্রেণীগুলেকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে পারে, এমন কোনো সংগঠন নেই। ইতিহাস ঘাটলে এমন বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ অতীতে এরকম উত্থানশক্তিহীন ছিলো না। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং নিম্নবিত্ত মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের তোড়ে ভূতপূর্ব পাকিস্তানের জঙ্গী লাট আয়ুব খানকে পর্যন্ত পরাজয়ে স্বীকার করতে হয়েছে। অথচ বর্তমান সময়ে দরিদ্র মানুষের একজন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পর্যন্ত নির্বাচিত করার ক্ষমতা নেই।
বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান স্থবিরতার কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের পেছনের দিকে না তাকিয়ে গত্যন্তর নেই। বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা মূর্তিমান হয়ে উঠেছিলো, তা অনেকের মধ্যেই আশাবাদ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো। সকলে আশা করেছিলেন বামপন্থী রাজনীতিই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। বামপন্থী রাজনীতির প্রবল প্রবাহে স্তরের পর স্তর বালু সঞ্চিত হয়ে মূল স্রোতধারাটিই রুদ্ধ করে ফেলেছে। বিভ্রন্তি বিচ্যুতির সে বালুরাশি খনন করে বামপন্থী রাজনীতির গতিমুখটি উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য অতীতের বিচ্যুতি এবং বিভ্রান্তিগুলোর দিকে অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকানো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের পূর্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কৃষক সমিতি যখন অবিভক্ত ছিলো, সে সময়টাই ছিলো বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। সমাজের ভেতর থেকে সেই সময়ে যে শক্তিপুঞ্জ জাগ্রত হয়ে উঠেছিলো সকলে আশা করতেন, হয়তো সেদিনের বেশি দেরী নেই, যখন এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে এই দেশে জনগণের কল্যাণমূখী একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন মতাদর্শগত কারণে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাচ্চা নেতা কে চীন না সোভিয়েত ইউনিয়ন, তা নিয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। একদিকে চীন, অন্যদিকে রাশিয়া। তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন এই সকল সংগঠন চীন রাশিয়ার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই চীন-সোভিয়েত বিরোধের কারণে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বামপন্থী আন্দোলনের ওপর প্রথম আঘাতটা আসে।
তারপরে ভারত আর চীনের মধ্যে যখন সীমান্ত যুদ্ধ সংগঠিত হয়, আমাদের দেশের বামপন্থী আন্দোলনে আরো একটা বিভক্তি নেমে আসে। বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত নেতা এবং কর্মী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দিতে থাকেন। অন্যদিকে মুসলিম সমাজ থেকে আগত বেশিরভাগ নেতা এবং কর্মী চীনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এই সময়ের হিন্দু কমিউনিস্ট এবং মুসলমান কমিউনিস্ট শব্দ দুটি সমাজে ব্যাপকভাবে চালু হয়ে যায়। বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে এই যে বিভক্তি ঘটলো, তার পেছনে আমাদের দেশের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির চাইতে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাবই সর্বাধিক সক্রিয় ছিলো।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসেন, মস্কো সমর্থক রাজনীতির অনুসারীরা পারস্পরিক বিবাদে রত ছিলেন। কিন্তু দুটি দলই ছয় দফা কর্মসূচীর নিন্দা করতে ছাড়লেন না। সে সময়ে রাশিয়া ভারত এবং পাকিস্তান মিলিয়ে চীন বিরোধী একটা ব্লক করার প্রস্তাব দিয়েছিলো। মূখ্যতঃ সে কারণে মস্কোপন্থী সংগঠনগুলো নিখিল পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার প্রতি অধিক যত্নবান হলেন। পরিতাপের বিষয় এই যে মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উনিশশো চুয়ান্ন সালে ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তি কাটি লিখে প্রকারান্তরে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জাতি সত্তার প্রশ্নটি তুলে ধরেছিলেন। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বার্থটা বড়ো করে দেখার কারণে তার লেখা পুস্তিকাটি অধ্যাপক সাহেব বেমালুম ভুলে যেতে পেরেছিলেন।