বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বয়স পঁচিশ বছর। কিন্তু বাংলাদেশী সমাজের বয়স হাজার হাজার বছর। সামাজিক সংকটগুলো সামাজিকভাবেই আমাদের সমাধান করতে হবে। সমাজের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিবেকবান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের একটা সত্য অনুধাবন করার সময় এসেছে, আমাদের সকলকে দেশে পাশাপাশি বসবাস করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা পেয়ে বেঁচে থাকার একটা মিলিত কৌশল আমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। অবশ্যই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব এতে অনেক বেশি।
.
০৭.
বাংলাদেশী রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতরো সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতি সেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিলতিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতি কর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন, সে কাহিনী এখনো প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। তাদের সাফল্যের পরিমাণ হয়তো আশানুরূপ ছিলো না। কিন্তু সূচনাটি করেছিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। সংস্কৃতিতে উত্তাপ, লাবণ্য এবং গতি সঞ্চার করার ব্যাপারে বামপন্থী সংস্কৃতি কর্মীরা অনেক কিছু দিয়েছেন। সেই সব মহান আবদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত এবং মুকলিত হয়। বাঙালী জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতা কর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সে জন্য তাদের জেল, জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ দলটির কাছ থেকেও তাঁদের কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি। পাকিস্তানের সংহতি বিনাশকারী, বিদেশী গুপ্তচর ইসলামের শত্রু এই ধরনের অভিযোগ বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে হামেশাই উচ্চারিত হতো। এসব লাঞ্ছনা সহ্য করেও বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরা ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতরেই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভ্রুণ রোপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেটুকু সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন, তার পেছনে রয়েছে বামপন্থী রাজনীতির বিপুল পরিমাণ অবদান। বামপন্থী রাজনীতিই শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত সমস্ত নির্যাতিত মানুষকে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগঠিত করেছে এবং আন্দোলনে টেনে নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বামপন্থী আন্দোলন এখন রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ উত্থানরহিত।
বামপন্থী রাজনীতির মুমূর্ষ অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যকে তমশাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই দেশটির সত্তর ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। অথচ এই দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতা যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক নিম্নবিত্ত মানুষ গুটিকয় মানুষের শোষণ পীড়নের শিকারে পরিণত হয়ে আসছে। তারা এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন নি, যার সাহায্যে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলার সুযোগ পান।
মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে শোষণের মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। তারা দেশে শিল্পকারখানা তৈরি করে দেশের বেকার সমস্যা সমাধান করতে পারেন না। অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতেও তারা অক্ষম। বাংলার ঘুণেধরা গ্রাম সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন করে নতুন সমাজ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা তাদের নেই। সংখ্যাধিক জনগোষ্ঠীর প্রাণপ্রিয় দাবী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাব্যবস্থা এসবের ব্যবস্থা তারা করেন না। আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ সৃজনী ক্ষমতা রয়েছে, সেটাকে মুক্তি দিয়ে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণও তাঁদের অভীষ্ট হতে পারে না। তারা নিজেদের শাসন শোষণের মাধ্যমে জরাজীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে গোটা সমাজটাকে এমন একটা কারাগার বানিয়ে রাখতে চান, যাতে করে মানুষ তার অধিকার কখনো ভোগ করতে না পারে। শাসকশ্রেণী সমাজের ওপর তাদের অপ্রতিহত শোষণ ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাবেদারী করে এবং আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতেও কুণ্ঠিত হন না। এই সমাজে শ্রমিক কৃষক মেহনতি সমাজের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এমন বলিষ্ঠ আন্দোলন সমাজের অভ্যন্তর থেকে জেগে উঠতে পারছে না। আমাদের রাজনৈতিক জীবনে বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব খুবই সামান্য। বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। তারা অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল উপদলে বিভক্ত। দেশের প্রকৃত বাস্তব পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণের বদলে অপ্রয়োজনীয় মতাদর্শগত বিতর্কে তাদের সময় কাটে। বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর পক্ষে সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনো রকমে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারলেও সে সকল প্রার্থী নির্বাচনে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। তাদেরকেও মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ধনিকদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়। এক কথায় বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতি সর্বপ্রকার উত্থানশক্তি হারিয়ে বসেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের কোনো অবস্থান না থাকার কারণে বেবাক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দক্ষিণপন্থী কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে। এই দুষ্টচক্রের ভেতর থেকে টেনে বের করতে না পারার কারণে গোটা রাজনীতিটাই পচে উঠেছে।