তারপরেও একটা কথা থেকে যায়। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, এই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হবে, সেই জিনিশটি কল্পনা করলেও আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার একটা বিষাক্ত স্রোত সাপের মতো এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রমশঃ বলবান হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের অবস্থানটি যদি নেপালের মতো হতো আমাদের দুশ্চিন্তা করার বিশেষ কারণ থাকতো না। নেপাল পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হওয়া সত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে নেপালের জনগণই সবচাইতে ভারত বিরোধী তা এক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে। সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক সংলগ্নতার কারণে ভারত বাংলাদেশ, হিন্দু মুসলমান এই সম্পর্কের ধরনগুলো সরল এবং একমাত্রিক নয়। সেই কারণে ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিরোধিতা এক হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনায়াসে হিন্দু বিরোধিতাও ভারত বিরোধিতায় রূপান্তরিত হতে পারে। মুসলিম দেশগুলোতে উখিত মৌলবাদের প্রভাব যেমন মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশকে প্রভাবিত করছে, তেমনি ভারতবর্ষের সজ্ঞা পরিবারভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর অনুসৃত মৌলবাদ হিন্দু সমাজের একাংশকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। মুসলিম মৌলবাদের পাশাপাশি হিন্দু মৌলবাদও সমাজের গভীরে শেকড় বিস্তার করছে। হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যালঘু এবং সামাজিকভাবে নির্যাতিত, মৌলবাদের প্রতি তাঁদের ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে বিষয়টার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দেখা গেলো এক সুপ্রভাতে স্বামী বিবেকানন্দের একটি মূর্তি তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ। স্বামী বিবেকানন্দের অন্য অনেক পরিচয় যাই থাকুক, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়টাই তাঁর অন্যবিধ পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিবেকানন্দের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় না। কিন্তু এখানে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে উম্মোচন করা হলো, তখনই মুসলিম শিক্ষকদের কেউ কেউ অগ্রণী হয়ে প্রস্তাব তুললেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল নতুন করে নামকরণ করা হোক। আরেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম পাল্টানোর প্রস্তাব করলেন। প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটিও অপ্রিয় বাক্য বিনিময় ছাড়া একটি সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় থেকে কতো দূরে সরে যাচ্ছে, এই সকল ঘটনার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে।
পাকিস্তান আমলে জগন্নাথ হল ছিলো শিক্ষা সংস্কৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সব চাইতে অগ্রসর ছাত্রাবাস। এই হলটি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতো। সাম্প্রতিককালে পূজা পার্বণ ধর্মীয় উৎসব এই হলে এতো অধিক পরিমাণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আতঙ্ক কতো অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুণদের অন্যবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলেই, তারা অধিক হারে ধর্মকর্মের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠছে। হ্যাঁ একটা কথা অবশ্য উঠতে পারে, ভারতের বিজেপির প্রভাবের কারণেই এসব ঘটছে। বাংলাদেশের মুসলমান ছাত্ররা যদি মাদ্রাসায় আফগানিস্তানের তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য গোপনে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে হিন্দু ছাত্রদের অনুরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অধিকার কেনো থাকবে না। যুক্তির পিঠে যুক্তি দিয়ে, কথার খেলা অনেক করা যায়। কিন্তু তাতে আসল সংকটের কোনো হেরফের হবে না।
একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশনের প্রক্রিয়া অনেকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। সেটা এখন এমন একটা আকার ধারণ করেছে, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু কারো পক্ষে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশন গ্যাংগ্রিনের মতো, সমাজ দেহের যে কোনো অংশে এর বিষক্রিয়া শুরু হলে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সংখ্যালঘুকে আশ্রিত ভেবে করুণা করা, কিংবা ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা উভয়ই ন্যায়তঃ স্বাধীন মানুষের নাগরিক সত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ। ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, পাকিস্তানের জন্ম, পাকিস্তানের ভাঙন আমাদের ইতিহাসের এই সকল ঘটনা একযোগে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশনের জন্ম দিয়েছে। অনুকূল পরিস্থিতিতে সেই ক্ষত শুকিয়ে আসতে থাকে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাতে পুঁজ রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ যে মূলচিন্তার উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই বোধ যদি পূর্ণ দৈর্ঘ্যে বিকশিত হতে পারতো, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ফারাক অবশ্যই কমে আসতো। যে সমস্ত সরকার বাংলাদেশ শাসন করেছে বা এখনো করছে, তারা সোচ্চার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হোক বা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কৌশলগত আনুগত্য প্রদর্শন করুক, কমবেশি সকলে এই অপরাধে অপরাধী। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মর্মবাণীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নির্যাতিত মানুষ যেখানে জন্মগত অধিকার ভোগ করতে পারে না, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমাজে অবস্থানগতভাবেই নির্যাতিত, তাই অন্য সকল নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সংগ্রাম জড়িত না করলে সম্প্রদায়গতভাবে তাদের মুক্তি অর্জন অসম্ভব। একমাত্র নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংগ্রামই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ফারাক রেখা মুছে দিতে পারে।