উনিশশো পচাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর পুরো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিই পাল্টে গেলো। পাকিস্তানপন্থী শক্তির ক্ষমতা দখল করার পর হিন্দুরা অধিকতরো অসহায় এবং জাতীয় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন। তারপরে জিয়াউর রহমানের আমলে এসে সংবিধানের যখন পরিবর্তন করা হলো, হিন্দু সমাজের হতাশা ঘনীভূত আকার ধারণ করলো। তাদের মনোভাব দাঁড়ালো এ রকম, বাপ, পিতামহের এই দেশটিতে আমাদের কোনো অধিকার নেই। এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের চূড়ান্ত রকম আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তথাপি আমাদের সামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আমাদের বসবাস করতে হয়। আমাদের পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ধান, বাগানের তরিতরকারী ঐ সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে যখন জোর করে কেটে নিয়ে যায়, আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনে। আমরা বিচার পাইনে, পুলিশ আমাদের কথা শুনে না, আইন আদালত করলে অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। আমরা স্কুলে কলেজে ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ বোধ করতে পারিনে। আমাদেরকে চাকরি বাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বৈষম্যের নীতি অনুসরণ করা হয়। আমরা কারবার তেজারত করে জীবন ধারণ করবো, সেরকমও ভরসা পাইনে। এই দেশটিতে থেকে আমাদের কী লাভ হবে। দলে দলে হিন্দুরা দেশত্যাগ করতে আরম্ভ করলেন।
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল হয়ে উঠছিলো, তার প্রভাব যে হিন্দুদের ওপর পড়েনি সে কথাও বলা যাবে না। চিত্তরঞ্জন সুতারের নেতৃত্বে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। সুতার বাবুর দাবী ছিলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তিনটি জেলা হিন্দু জনসাধারণের বসবাসের জন্য আলাদা করে দেয়া হোক। হিন্দু মৌলবাদী শক্তি চিত্তরঞ্জন সুতারকে দিয়ে এ আন্দোলনটি সৃষ্টি করিয়েছিলো। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার জন্য বঙ্গভূমি আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছে। এরশাদ ক্ষমতায় এসে সংসদে আইন পাশ করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দেশত্যাগের মাত্রা অধিক হারে বেড়ে গেলো। নানা রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো বটে, কিন্তু আইনটি রদ করা সম্ভব হলো না। উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অধিকতররা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভের পরও দেখা যাচ্ছে আইনটি যথাযোগ্য বহাল রয়েছে।
উনিশশো একানব্বই সালে ভারতে বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদীরা মোগল সম্রাট বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে, ওই জায়গায় শ্রীরামচন্দ্রের নামে একটি মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে। তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক মুসলমানেরা হামলা শুরু করেন। হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো হয়, তাদের দোকান পাট ভেঙ্গে ফেলা হয়, তাদের মন্দির ও দেবালয় শয়ে শয়ে ধ্বংস করা হয়। খালেদা জিয়ার সরকার দাঙ্গা প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করলেন না। অপর প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ব্যপক মুসলমানের কাছে অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে হিন্দুদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারলেন না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকে অনেকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। উনিশশো একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতাও তাদের সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু উনিশশো একানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসজনিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে অন্য কোনো নিষ্ঠুরতার তুলনা চলে না। তারা চূড়ান্ত অসহায়তা সহকারে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হলেন, কী প্রচণ্ড আক্রোশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তারা মর্মে মর্মে অনুভব করলেন, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আক্রোশ, সময় বিশেষে তা সাইক্লোন, সমুদ্র প্লাবন কিংবা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের চাইতেও মারাত্মক হতে পারে।
এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাত হিন্দু সম্প্রদায়ের সংবেদনাকে এতোটা আহত করেছে, তারা বাংলাদেশে নির্ভর করার মতো কোনো অবলম্বনই খুঁজে পেলেন না। কোন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের মতো মানুষকে ভোরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন দাবী করতে হয়, তা অনুমান করতে কষ্ট হয়না। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি অবিশ্বাস, সংশয় এবং আতঙ্কের কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরা অপর দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধদের নিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পেছনের উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক না কেননা, বাস্তবে তার কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে একথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তারপরেও এই ধরনের সংগঠনের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। মুসলমানেরা যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে পারে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থেকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অত্যাচারের শিকার হওয়ার চাইতে সাম্প্রদায়িকভাবে সংগঠিত প্রতিবাদ রচনা করা অনেক পুরুষোচিত কাজ।