এই সমস্ত কারণ ছাড়াও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা গাঢ়মূল হওয়ার একাধিক আন্তর্জাতিক কারণ বর্তমান। আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, ইরান, মিশর এই সকল মুসলিম দেশে মৌলবাদের উত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশ মুসলমান প্রধান দেশ হওয়ায় মুসলিম জগতের চলমান ঘটনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে না। কিছু না কিছু প্রভাব আবশ্যই পড়ে। আরো একটি বিষয় অবশ্যই স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙ্গন, ক্যুনিজমের ভরাডুবি এবং সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় একগুচ্ছ মুসলিম রাষ্ট্রের আকস্মিক আবির্ভাবের কারণে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পৃথিবীতে তাদের প্রভূত্বমূলক আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে আরম্ভ করেছে। পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা বলেছেন, আগামীতে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে যদি অন্য কোনো শক্তির সংঘাত বাধে তাহলে প্রথম সংঘাতটি বাধবে ইসলামের সঙ্গে এবং দ্বিতীয় সংঘাতটি হতে পারে কনফুসীয়পন্থী চীনের সঙ্গে। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসলাম ধর্মের প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব করার জন্য দুনিয়া জোড়া নানা কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। মুখ্যতঃ আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মুসলিম দেশগুলোতে এক ধরনের ধর্মীয় পুনরুত্থান জেগে উঠছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এই সামাজিক রূপান্তরটা এতো চুপিসারে, নীরবে ঘটছে যে, কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তার প্রভাব অস্বীকার করা অসম্ভব নয়। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে এই সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কিছু কিছু স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সশস্ত্র হামলার মুখে ঘরবাড়ি দেশ ফেলে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নয় মাস পর দেশে ফিরে দেখেন তাদের ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই। তাদের দোকানপাট, জমিজমা, পুকুর এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দখলে চলে গেছে। এই দখলদার সংখ্যাগুরুদের মধ্যে সকলে পাকিস্তান ভক্ত নয়, সরকার সমর্থক দেশপ্রেমিক জনগণেরও অভাব নেই। বেশিরভাগ হিন্দুকে তাদের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি যা কিছু হাতের কাছে ছিলো সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই নয় মাসে তার সবটাই নিঃশেষ করে ফেলতে হয়েছে। সম্পূর্ণ কপর্দকহীন অবস্থায় ঘরবাড়ি আবার নতুন করে গড়ে তোলার কাজে মন দিলেন। তাঁদের হাতে কোনো সহায় সম্পদ নেই। সরকার তাদের পুনর্বাসনের কাজে কোনোরকম সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করলেন না। সংখ্যাগুরু প্রতিবেশীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি পর্যন্ত তারা পেলেন না। তথাপি তাদের মনে একটা সান্ত্বনা ছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা আর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নন। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক বিষয়ের সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুদের মতো তাদের সমান অধিকার। ঘরবাড়ি তৈরি করে থিতু হয়ে বসার পরে তারা যখন অধিকার বোধটা ব্যবহার করতে চাইলেন, তারা কল্পনাও করতে পারেননি এই স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের জন্য মর্মান্তিক আঘাতটা অপেক্ষা করছিলো। স্বাধীনতার এক বছর না যেতেই পাকিস্তান আমলের চাইতেও জোরালো সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি তাদের দাঁড়াতে হলো। স্বাধীনতার পর প্রথম দুর্গোৎসবটাতেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নরায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং বরিশালের নানা জায়গায় দুর্গাপ্রতিমা ভেঙ্গে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণে বাধা দেয়া হলো। ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিরোধিতা এক হয়ে গেলো। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধি যে স্বাধীনতা উত্তরকালে নতুন করে নতুনভাবে জাগ্রত হয়ে সাম্প্রদায়িক দূরত্বের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা এক রকম প্রায় দুঃসাধ্য করে তুলেছে, তার জন্য আরো কতিপয় বিষয় পর্যালোচনার প্রয়োজন।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আয়ুব খান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়িসহ পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে এক অর্ডিন্যান্স বলে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান আমল থেকেই এই নাগরিক অধিকারবিরোধী আইনের প্রতিবাদ করে আসছিলো, কিন্তু ফলোদয় হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা আশা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এই আইনের নামটা পরিবর্তন করে শত্রু সম্পত্তির স্থলে অর্পিত সম্পত্তি রাখলেন, কিন্তু কার্যকারিতা একই রকম থেকে গেলো। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন তাঁদের এক রকম ভরসাস্থল, তার এই ধরনের সংবেদনহীনতা হিন্দুদের চূড়ান্তভাবে হতাশ করলো। উনিশশো একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রমনার বহু পুরোনো কালীবাড়ি ধ্বংস করে। ওই একাত্তর সালেই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিক চাপে বাধ্য হয়ে রমনা কালীবাড়ি পুননির্মাণের টেন্ডার আহবান করেছিলেন এরকম শোনা যায়। যাহোক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে রমনার কালীমন্দির পুনঃনির্মাণ করার অনুমতি পাননি। শেখ মুজিবুর বোধকরি তাদের বলেছিলেন, ওই নাজুক সময়ে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলে তাঁর সরকারের বিপদ হতে পারে। এইভাবে খোদ মুজিব শাসনামলেই তাদের একটার পর একটা আশাভঙ্গ ঘটতে থাকে।