এই ধরনের কুয়াশাচ্ছন্ন একটা পরিবেশে পাকিস্তানের সমর্থক গোষ্ঠী মুসলিম বাংলা গঠন করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যেতে আরম্ভ করলেন। এখানে সেখানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান হতে থাকলো। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী সরকারী নীতি এবং আদর্শের সমর্থক ছিলেন সমাজের তৃণমূল থেকে উখিত সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান তারা গ্রহণ করতে পারেননি। দেশের বিবেকবান মানুষের কাছে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা অবশিষ্ট ছিলো না। মুসলিম বাংলার সমর্থকরা মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় সভাগুলোতে ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করলেন, ভারত পাকিস্তানকে হটিয়ে গোটা বাংলাদেশটা দখল করে বসেছে। এই দেশে মুসলমানদের ধন, প্রাণ, ঈমান কিছুই নিরাপদ নয়। শতত ধারায় এই ধরনের নেপথ্যে প্রচারের কারণে সমাজের ভেতর থেকে ঘূর্ণিহাওয়ার মতো সাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগ্রত হয়ে জনমানসে জীবাণুর মতো প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করলো।
দক্ষিণপন্থী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে, অনেকগুলোই সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যে দলটি দায়ী সেই পাকিস্তান মুসলিম লীগ উনিশশো চুয়াল্লোর নির্বাচনে সেই যে ধরাশায়ী হয় আর কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। জেনারেল আয়ুব মুসলিম লীগের একটি অংশকে নতুন জীবন দান করতে চেষ্টা করেছিলেন। আয়ুবের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র একটা নিপ্রাণ অস্তিত্বে পরিণত হয়। এই দলগুলোর মধ্যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই ছিলো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাই সবচাইতে বেশি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা সর্বতোপায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীতা করেছেন। রাজাকার আলবদর, আলসামস্ ইত্যাদি যে সকল সন্ত্রাস সহায়ক বাহিনী যুদ্ধকালে সৃষ্টি করা হয়েছিলো, তার সিংহভাগই এসেছে জামায়াতে ইসলামী দলটি থেকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করার পর জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ কর্মীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। কিছু অল্প সংখ্যক অপরাধীই ধরা পড়ে। এই অপরাধীদের অনেকেই নগদ অর্থের বিনিময়ে সরকারের লোকদের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বেশ কিছু অংশ নানা কৌশল অবলম্বন করে সৌদী আরব, কুয়েত, ইরান ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশে চলে যায়। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমও পাকিস্তান থেকে সৌদি আরবে চলে আসেন। মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং কুয়েতে এই সকল পলাতক জামায়াত সদস্য নিজেদের সংগঠিত করে সঘবদ্ধভাবে জোরালো প্রচার চালাতে আরম্ভ করেন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য লন্ডন অফিসটি ব্যবহার করতে থাকেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যের সকলশ্রেণীর মানুষদের বোঝাতে থাকেন যে বাংলাদেশে ইসলাম সত্যি সত্যি বিপন্ন। ভারতের হিন্দুরা বাংলাদেশ দখল করে ফেলেছে। বাংলাদেশে অনেকগুণ বেশি ইসলামকে জীবিত রাখতে হলে সেখানে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কেনোনা মসজিদ এবং মাদ্রাসাই ইসলামকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র গ্যারান্টি।
মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তাঁদের কথা বিশ্বাস করেছেন। মসজিদ মাদ্রাসা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থে বাংলাদেশের শহর বন্দর থেকে শুরু করে একেবারে নির্জন গ্রামে পর্যন্ত অনেক মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। একটা পরিসংখ্যান নিলে জানা যাবে পাকিস্তান বিগত পঁচিশ বছরে যতো পরিমাণে মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি হয়নি, বাংলাদেশ আমলে পঁচিশ বছর সময়ের মধ্যে তার চাইতে অনেকগুণ বেশি মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যেখানে একটি মাদ্রাসা নেই। বর্তমানে মাদ্রাসা গ্রাম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী হতে হলেও মাদ্রাসার সমর্থন লাভ জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের শহরগুলোতে তারা পরিকল্পনা করে এমন কতিপয় মসজিদ নির্মাণ করেছেন যার সঙ্গে এক একটি সুপার মার্কেট সংযুক্ত রয়েছে। এই সব মার্কেট থেকে ভাড়া ইত্যাদি বাবদে যে অর্থ আদায় হয় তার এক ভগ্নাংশ মাত্র মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যয় করা হয়। বাকী বিপুল পরিমাণ অর্থ ধর্মীয় রাজনীতির পেছনে ব্যয়িত হয়। মসজিদ ছাড়া তারা ক্লিনিক, হাসপাতাল, ব্যাংক এবং আরো নানা রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে, দেশের ভেতর থেকেই একটা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে ফেলেছেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি একটা শক্ত আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই মাসে মাসে মাসোহারা দিয়ে বিপুল সংখ্যক কর্মী এবং প্রচারক পোষা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় না। রাজনৈতিকভাবে সমাজে আশানুরূপ অগ্রগতি না হলেও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা শক্তি সগ্রহ করে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুজিব সরকারের আমলে শিক্ষা সংস্কারের কথা উঠলেও জনমত বিপক্ষে যায় এই আশঙ্কায় তিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় হাত দিতে সাহসী হয়ে উঠতে পারেননি। জিয়ার আমলে এই মাদ্রাসাসমূহকে সরকারের সমর্থন ক্ষেত্রে পরিণত করার একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরশাদ আমলে মাদ্রাসাসমূহের মধ্যে ধর্মীয় রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার ক্রটি করা হয়নি। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে মাদ্রাসাসমূহ যে পরিমাণ সরকারী অনুদান পেয়েছে, তা মাধ্যমিক স্কুলগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থের চাইতে বেশি।