স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হত্যা করে যদি একদলীয় শাসন কায়েম করে না বসতো স্বৈরাচারী শক্তি সমাজের ওপর জেঁকে বসে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন, সমস্ত প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে পারতো না। যে জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশটিকে স্বাধীন করেছে, সে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগকেও তার বলি হতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা স্বৈরশাসনের পেছনে এমন কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, এমন কোনো ভাবাদর্শিক জাগরণ রচনা করতে পারেননি, যাতে করে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের সার্থক প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সাম্প্রদায়িক শক্তির সহায়তায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের সঙ্গে আপোষও তাদের করতে হয়েছে। সরকার সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা সেই একাত্তর সালের পরবর্তী সময়ের মতো উচ্চকণ্ঠে অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এই সকল প্রত্যয়ের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছেন। তাদের অবস্থানগত স্ববিরোধিতা একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেই সকলের দৃষ্টিতে উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়বে। তাঁরা ইনকিলাব পত্রিকা যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছে, তার বিরুদ্ধে জেহাদ করতে প্রস্তুত, কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক আরোপিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত গুলিস্তান রমনা কালীবাড়ি পুননির্মাণের ন্যায়সঙ্গত দাবী যখন হিন্দু সম্প্রদায় থেকে উত্থাপিত হয়, তারা অতিরিক্ত দার্শনিক হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ এটাকে এমন একটা দুরূহ দার্শনিক সমস্যা মনে করেন, হঠাৎ করে জবাব দেয়ার কিছু নেই এমন মনে করে থাকেন। (অর্পিত) শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবী যখন ওঠে, এগুলো তাঁদের বিজ্ঞ মস্তকে স্থান পাবার উপযুক্ত বিষয় মনে করেন না।
দোদেল বান্দা কলমা চোর, না পায় শ্মশান, না পায় গোর। এঁদের অবস্থা অনেকটা সেরকম। এঁরা একটা সরকারকে সমর্থন করছেন, কিন্তু তার পেছনে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো মূল্যবোধ কাজ করছে সে কথা নিজেরাও মনে করেন না। সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক হওয়ার বদলে ছদ্মবেশী অসাম্প্রদায়িক সাজার পরিণাম কতো ভয়াবহ হতে পারে আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে। সরকারী দলের বুদ্ধিজীবীরা যে সুবিধাবাদী অবস্থানটিতে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদের অভিভাবক এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ বলে নিজেদের পরিচিত করতে চেষ্টা করছেন, সেই জায়গাটি ভয়ঙ্কর নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি বাহাত্তরের পরবর্তী সময়ের চাইতেও অনেক সংগঠিত এবং পরিকল্পিতভাবে তাদের জায়গাটি কেড়ে নিতে ছুটে আসছে। সে শক্তিকে প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা তাঁদের নেই, তাঁদের সততা নেই। তাদের বিশ্বাস এবং প্রত্যয়ের কোনো বালাই নেই। অতীতে তা আমাদের জাতিকে ভুল পথে চালিত করেছেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সুফলটুকু ভোগ করছেন।
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক এবং প্রতিশীল শক্তির সংগ্রাম অধিকতররা জটিল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ত সল সাম্প্রদায়িক এবং নকল প্রগতিশীল সুবিধাবাদীদের যুগপদভাবে পরাস্ত করতে না পারলে বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির উত্থান অসম্ভব। কাজটি সত্যি সত্যিই কঠিন।
.
০৬.
উনিশশো একাত্তর সালে দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার সবগুলো ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করে এবং তাদের কার্যকলাপ বেআইনী বলে চিহ্নিত করে। তার ফলে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ, নেজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ এই সকল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা বন্ধ হওয়ার ফলে, তারা গোপনে তাঁদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে আরম্ভ করেন। যেহেতু প্রকাশ্যে তাদের সভা ও সমাবেশ এবং শোভাযাত্রা করার অধিকার ছিলো না, তাই তারা ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঁধে ভর করেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই পংক্তিটা আছে না, নিন্দাকে রসনা হতে দিলে নির্বাসন, গভীর জটিল মূল অন্তরে প্রসারে–বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই জিনিশটি ঘটতে আরম্ভ করলো।
তারা মসজিদ এবং মাদ্রাসাসমূহকে তাদের কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করতে থাকলেন। ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় জলসা, নবীর জন্ম মৃত্যু তারিখে দশ পনেরো দিন ব্যাপী সিরাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকলেন। পাকিস্তান যতোদিন টিকে ছিলো সমাজের ভেতর থেকে এই ধরনের ধর্মীয় জিগীর কখনো উখিত হতে দেখা যায় নি। অথচ ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই সকল প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। সেই সময়ে বাংলাদেশে কোনো মানুষের ধনপ্রাণের নিশ্চয়তা নেই। একদিকে চলছে রাজনৈতিক নিষ্পেষণ অপরদিকে সরকারী সন্ত্রাসের মোকাবেলা করার জন্য চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাল্টা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে যাচ্ছিলো। দেশে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই ধরনের একটা সংকটজনক সময়সন্ধিতে দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকার কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছে না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সরকার ইচ্ছা করলেও হয়তো অধিক কিছু করতে পারতেন না। নানা ধরনের সমস্যার ভারে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের স্বচ্ছতার ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার কারণও ছিলো। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় একদল মানুষ রাতারাতি ধনী হয়ে উঠলো। তারা দোকান, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসকল দখল করতে থাকলো।