মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার সময় যে সমস্ত বোধ এবং উপলব্ধি সক্রিয় ছিলো, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর দেখা গেলো সে সমস্ত বোধ এবং উপলব্ধিগুলোকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি সত্যি সত্যি দুরূহ। বাংলাদেশে ভাষা ভিত্তিক যে জাতীয় রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে তার সাংস্কৃতিক চেহারার একটি নির্দিষ্ট আকার দান করার প্রশ্নটা যখন উঠলো, তখনই প্রকৃত সংকটটা আত্মপ্রকাশ করলো। বাংলাদেশে যে নতুন রাষ্ট্রসত্তাটি জন্ম নিয়েছে, তার যে দাবী সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই অঞ্চলের সংখ্যাগুরু অধিবাসী মুসলমান। শুধুমাত্র ধর্মের বন্ধনকে মান্য করে দেড় হাজার মাইল দূরবর্তী একটি অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে এক রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস সম্ভব নয় বলেই নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্র গঠনের উপাদান হিসেবে ধর্মের স্থান থাকতে পারে, সেই প্রত্যয়টা খারিজ করে দিয়েছে। তারপরেও একটা প্রশ্ন মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী যাদের বেশির ভাগ দরিদ্র এবং নিরক্ষর, তাদের জন্য নতুন সমাজের প্রয়োজনে ধর্মের অভিভাবকত্বহীন একটা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল ধর্মের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জটা যখন সামনে এলো, দেখা গেলো বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তার সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা, প্রস্তুতি, মেধা এবং মানসিকতা কোনোটাই নেই। যুদ্ধোত্তর বালাদেশে একটি সাংস্কৃতিক রেনেসার প্রয়োজন সবচাইতে অধিক ছিলো। একটি সর্বব্যাপ্ত জাগরণ, নতুন মানসিক বোধের উদ্বোধন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক একটি উত্থানের ঢেউ লেগে শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের কোনো শাখা হৃদ্য, সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে যে সকল ব্যক্তি, পাকিস্তান সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ভেতর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি কখনো ক্ষীণ, কখনো জোড়ালো সমর্থন ব্যক্ত করার চেষ্টা করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় তারা একটা নিরাপদ অবস্থান পেয়ে গেলেন। দেশটির সংস্কৃতির অভিভাবক নতুন ব্রাহ্মণের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় আত্মতুষ্টি এবং তোষামোদের এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে আরম্ভ করলেন, বাঙালী জনগোষ্ঠীর মুক্তি সংগ্রামের তরঙ্গ তার মধ্যে ধ্বনিত হয়ে উঠলো না। কৃষক, মজুর, দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক আত্মত্যাগ করেছে, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কোনো চিহ্নই তাঁদের চিন্তা চেতনায় স্থান করে নিতে পারেনি। তারাও বাঙালীর রাষ্ট্র, বাঙালী জনগণের কথা বলতেন, কিন্তু সেগুলো বিমূর্ত ধারণার অধিক কিছু ছিলো না। বাস্তবে যে বাঙালী জনগণ প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম সম্ভাবিত করেছে, সেই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান জনগণকে এক সূত্রে বেঁধে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার স্বপ্ন কখনো তাদের মনে সঞ্চারিত হয়নি।
যে সাংস্কৃতিক নেতৃশ্রেণীটি বাংলাদেশ আমলে জাতির শিরোভাগে চলে এসেছিলো, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেই তাদের বিকাশ এবং সংবৃদ্ধি। তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য তারা পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতা করতেন, আবার বাঙালি জনগণের উত্থানের সম্ভাবনা দেখে, নিজেদের বাঙালিত্বের পরিচয়টাও তুলে ধরতে চেষ্টা করতেন। এই শ্রেণীর মানসিক দোলাচল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভিভাবক হয়ে বসলেন, দেখা গেলো তাদের সৃষ্টিশক্তি অবসিত হয়ে গেছে, নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের নেই।
রাজনীতির ক্ষেত্রে যে জিনিশটি ঘটেছে, দেখা গেলো সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে আরম্ভ করেছে। পশ্চিম বাংলা থেকে যে সকল মুসলমান বুদ্ধিজীবী জিন্নাহ্ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির আশায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন, তাদেরই একটা অংশ আচকান শেরোয়ানী পাল্টে গলায় খদ্দর ঝুলিয়ে তারস্বরে নিজেদের বাঙালী বলে জাহির করতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের এই উচ্চারণগুলো ছিলো মেকি ভড়ং সর্বস্ব, একটি নতুন জাতির বিকাশ সম্ভাবিত করার জন্য তাদের পালনীয় কোনো ভূমিকা ছিলো না। জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করার বদলে তাঁরা বিভেদের বীজই বপন করলেন।
উনিশশো পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেখা গেলো, একাত্তরের পরাজিত শক্তিসমূহ আবার মাথা তুলতে আরম্ভ করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই সমস্ত শক্তিকে পাতাল প্রদেশ থেকে টেনে তুলে আমাদের সমাজ জীবনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ একে একে ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। সমস্ত পরিবেশটা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষিয়ে তোলা হলো। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের প্রতাপ অধিকতরো বিস্তৃত হয়ে পড়লো। সংস্কৃতির গতিপথটার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য নিত্যনতুন কৌশলের উদ্ভাবন করা হতে থাকলো। বাঙালীত্বের বিপরীতে মুসলমান পরিচয়টা খুঁচিয়ে বের করার জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত রইলো না। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটি জন্ম নিয়েছে তার প্রকৃত পরিচয় মুছে দিয়ে দেশটিকে আবার নতুন পাকিস্তানে পরিণত করার সর্বাত্মক পাঁয়তারা করতে থাকলো। সমাজের ওপর হতে তলা পর্যন্ত সর্বত্র পশ্চাদপদ ধারণা রাজ্যপাট বিস্তার করতে আরম্ভ করলো।