পরিবর্ধিত সংস্করণের ভুমিকাঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা
সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (প্রবন্ধ) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – আততায়ীর গুলিতে নিহত
কবি হুমায়ুন কবির-এর
স্মৃতির উদ্দেশ্যে
পরিবর্ধিত সংস্করণের ভুমিকাঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশো বাহাত্তর সালে। এখন উনিশশো সাতানব্বই। এরই মধ্যে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। যখন লেখাটি প্রকাশিত হয় আমার বয়স বড়জোর আটাশ। বিগত পঁচিশ বছরে এই লেখাটির অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য করেছিলো। দৈনিক গনকন্ঠ পত্রিকায় সতেরোটি কিস্তিতে আমি লেখাটা লিখি। পরে বই আকারে প্রকাশ করি। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর লেখাটি নানা লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে রাজনীতি সচেতন তরুণদের কাছে লেখাটি আশাতীত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই পুস্তকে প্রকাশিত নানা মন্তব্য পাঠকদের মধ্যে এতো সাড়া জাগিয়ে তুলেছিলো, সেকালে যাঁরা তরুণ ছিলেন তাঁদের কারো সাথে দেখা সাক্ষাত হয়ে গেলে এই বইটির বিশেষ পংক্তি তাঁরা এখনো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকেন।
এই রচনাটি লেখার পূর্বে বিশষ ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ আমি পাইনি। স্বতঃস্ফুর্ত আবেগে বেবাক রচনাটি লিখে ফেলেছিলাম। লেখার সময় কখনো মনে হয়নি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আশয় নিয়ে আমি সিরিয়াস একটা পর্যালোচনা হাজির করতে প্রবৃত্ত হয়েছি। যেহেতু এ লেখাটি লিখতে আমাকে কোনো বেগই পেতে হয়নি, তাই কি লিখলাম এ নিয়ে আমি বিশেষ মাথা ঘামাবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। আমার অন্যান্য রচনার পেছনে যে শ্রম অভিনিবেশ এবং যত্ন আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার ভগ্নাংশও এই রচনার পেছনে ব্যয় করতে হয়নি। তাই এ লেখার সঙ্গে আমার প্রাণের অনুভূতির সংযোগ অতোটা নিবিড় নয়। যদি লোক সমাজে বিশেষভাবে আলোচিত না হতো, হয়তো এই রচনাটির কথা আমিও ভুলে যেতে পারতাম। সৃষ্টিশীল আবেগের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত হলেও এই রচনায় আমি এমন কিছু মতামত প্রকাশ করেছিলাম, সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন মানুষ, সেগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। এই বইয়ের পাঠকেরাই আমাকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ বইটি যেহেতু আমার কলম থেকে বেরিয়েছে সুতরাং গ্রন্থ প্রকাশিত মতামতের দায়দায়িত্বও আমাকে বহন করতে হবে। এখানে আমি সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই, আমার সাধ্যমতো সেই দায়দায়িত্ব আমি বহন করছি।
মাঝে মাঝে এমন চিন্তাও আমার মনে আসে, লেখাটি যদি না লিখতাম, হয়তো আমার জীবন অন্য রকম হতে পারতো। এই লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীভূক্ত এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মতো তাড়া করছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে স্বস্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনোদিন পাবো, সে ভরসাও করিনে। তথাপি এই রচনাটি লেখার জন্য এক ধরনের গর্ব অনুভব করি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বছরগুলোতে অবিচার, অনাচার নির্যাতন, রাষ্ট্রশক্তির সক্রিয় হস্তক্ষেপ যখন সামাজিক বিবেকের করুদ্ধ করে ফেলেছিলো, স্বৈরাচারের প্রবল প্রতাপে উদ্ধত অন্যায় যখন ন্যায়ের বসন পরে অসহায় সমাজের ওপর দ্রুকুটি নিক্ষেপ করেছিলো, রাজরোষের ভয়ে বিবেকবান মানুষ মুক হতবিহ্বল চণ্ড শাসনের সেই নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে আমি জ্বলে উঠতে পেরেছিলাম। এটা অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে ওঠার মতো কিছু না হলেও নিতান্ত সামান্য বিষয় মনে করিনে। প্রতিটি দ্রোহ, প্রতিটি প্রতিবাদ, তার শাস্তির দিক যেমন আছে তেমন পুরস্কারেরও একটা ব্যাপার এতে রয়েছে। শাস্তির কথাটা বলেছি। এখন পুরস্কারের কথা বলি। ন্যায়ের পক্ষে যারা কথা বলে, কাজ করে মানবহৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মানবোধ তাদের অভিমুখে ধাবিত হয়। এই ছিপছিপে গ্রন্থটি রচনা করার কারণে তরুনতরো প্রজন্মের মনে আমি একটা স্থান করে নিতে পেরেছিলাম। এই লেখাটা নিয়ে পঁচিশ বছর আগে যেভাবে আলোচনা হতো, এখনো নানা জায়গায় সেরকম আলোচনা হতে দেখি। সেই জিনিশটাকেই আমি পুরস্কার বলে ধরে নিয়েছি।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হওয়ার পর যখন সকলে লেখাটির তারিফ করতে থাকেন, আমাদের দেশের কৃতবিদ্য লোকদের কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে প্রতিবাদী বই পুস্তক লিখতে আরম্ভ করেন। সেগুলো যদি যথার্থ দ্রোহ এবং প্রতিবাদ ধারণ করতে পারতো তাহলে আমিই সবচেয়ে বেশী সন্তোষ বোধ করতে পারতাম। অন্ততঃ মনে করতে পারতাম আমি নেহায়েত অরণ্যে রোদন করিনি। আমার উত্তাপিত কণ্ঠস্বরে সাড়া দেয়ার লোক পাওয়া গেছে। আমি একা নই। কিন্তু আমাকে নিদারুণভাবে হতাশ হতে হয়েছে। এই ভদ্রলোকদের রচনাসমূহে বাকচাতুর্য আছে, কিন্তু প্রতিবাদের আগুন নেই। পণ্ডিতদের এই ধরনের ভাবের ঘরে চুরি করার কসরত দেখ দেখে আমি প্রায় স্থির সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছি, সম্মানের কাঙ্গাল মানুষেরা কি ধরনের সামাজিক উৎপাতের কারণ হতে পারেন। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে যখন আমি বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের সঙ্গে পরবর্তীকালে পণ্ডিতদের প্রকাশিত পুস্তকগুলোর তুলনা করি, কেনো জানি আমার সেগুলোকে তাজা বোমার পাশে সার সার ভেজা পটকার মতো মনে হতে থাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনাটির প্রতি আমার অন্য এক বিশেষ কারণে একটা বিরক্তি বোধ রয়েছে। যথেষ্ট না হলেও সাহিত্যের নানা শাখায় অবশ্যই কিছু দাহিকাশক্তিসম্পন্ন রচনা আমি লিখেছি । এই সকল রচনায় আমার মনন, মেধা এবং শ্রমের অধিকাংশ ব্যয় করেছি। কিন্তু মানুষ অনেক সময়ে আমার সাহিত্যকর্ম বলতে একমাত্র এই ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’র উল্লেখ করে থাকেন। যদিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি, এই জিনিশটি আমাকে খুবই আহত করে। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, লোকে ওই লেখাটার কথা বলে কেনো? আমার অন্যান্য রচনার কি কোনো সাহিত্য মূল্য নেই। আমার অন্যান্য রচনাকে আড়াল করে রাখার জন্য এই বইটির প্রতি একটা চাপা নালিশ সবসময়ই পুষে আসছিলাম।