সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১০
জেব্রা! – সৈয়দ শামসুল হক
বাংলার প্রান্তরে হঠাৎ আফ্রিকার সাভানার রোদ ঝলসে ওঠে।
তুমিই কি? থেকে থেকে লাফিয়ে উঠতে চাও কোলে।
আমি স্তম্ভিত। এই তুমি! বন্য ও উদ্দাম! এবং উৎকর্ণ।
চাবুকের শব্দ সপাং সপ। বাতাস হচ্ছে রক্তাক্ত।
তোমার ভীতিগুলোই কালো কালো ডোরা—
তোমার মখমল শুভ্রতায় সেই কালো ডোরা—
পোষ-না-মানা তোমার সত্তাকে যারা
চাবুকের তাড়নায় ছিন্ন করে,
তাদেরই তো দাগ তোমার কালোসাদা শাড়িতে।
এবং লাল ফোঁটা মাঝে মাঝে!
তোমার তো রক্তাক্ত হবার কথা নয়।
বরং তুমিই সেই উজ্জ্বল লোহিতের দিকে চোখ পেতে আছো
যা নববধূর অঙ্গে ভোরের নদীটির স্রোতের মতো
প্রবাহিত হয় শাড়ি থেকে!
তুমি এখন শব্দিত হয়ে উঠছ।
তুমি বারবার লাফিয়ে উঠতে চাইছো আমার নিঃসঙ্গ কোলে।
ও আমি তোমার সবুজ প্রান্তর! তোমার অবাধ বিচরণভূমি!
রোদ গলে পড়া জলাশয় যে আমি তোমারই।
আমি তোমার ঘুমিয়ে পড়বার ছায়া-বিতান।
তোমার খুরের দাপট!
তোমার জন্মসহচর স্বাধীনতা।
জেব্রা! অরণ্য থেকে প্রান্তরে!
প্রান্তর থেকে সত্তার এখনো সবুজ চত্বরে।
এবং সেই চত্বরেও তুমি শমিত বা শান্ত নও,
আমার মানব-শরীরে
তুমি জেব্রা উপগত! তুমি ও আমি!
আমাদের ভেতরে জেব্রার দুরন্ত বন্যা—জেব্রাপালের বিশুদ্ধতা
এবং গতিবেগ—মহাদেশ ভেঙে এই বদ্বীপেই তো—
এই গতিবেগেই তো লাফিয়ে ওঠে অক্ষর আমার কলমে
এবং লিখিত হয়ে চলে আমাদের ভালোবাসার বিদ্যুতলেখা।।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৩, ২০১১
দরজা – সৈয়দ শামসুল হক
তাহলে দরজারই সমুখে! সেই দরজা! তোমার দরজা!
একদিন যে-দরজা ছিল গরমের খরতাপে বন্ধ ও রঙচটা!
কত সড়কেই না আমি সন্ধান করেছি এমন একটি দরজা
যার পাল্লার কাঠে এসে পড়বে শ্রাবণ-বৃষ্টির সন্তাপহর ধারা।
কিন্তু বিবর্ণ এই সময়, আর আমিও দেখো কী রকম বটে—
তিমির পেটের ভেতরে প্রত্যাদিষ্ট একজন আছি অপেক্ষায়,
কখন বেরুব! তাঁর অপেক্ষারই চাপ আমার সব উচ্চারণে।
একটি বেদনাবৃক্ষ লেবু ফলিয়ে চলেছে জ্যোৎস্নার ভেতরে,
আর সেই জ্যোৎস্না তো আসলে ছিল তোমার ভালোবাসা।
তোমাকে ভালোবেসেই তো আমি দূরপাল্লার যাত্রী, আমি
লেবুগন্ধে মাতাল, আমি প্রতি স্বজনেরই তো দৈনন্দিন পাতে।
সন্ধান আমার শেষ হয় না। দাঁড়াও!—আমি নিজেকে বলছি!
আর এটাও বলে চলেছি, সড়ক তোমাকে একদিন তো ঠিক
ফেরাবেই তোমার প্রার্থিত দরজায়, না হয় এখন খরায়!
নিপুণ তীর, তীক্ষ তীর, রক্তমুখী ভোর, নির্জন সব সড়ক।
এই সব দেখে দেখে নিজের ভেতরেই এক বিচলন আমি
নীলগাইয়ের মতো অনুভব করে চলেছি সেই কতকাল থেকে!
কাল? তার বর্ণটাই বা কেমন? সে কি ঘোর কৃষ্ণলেপিত?
পাটল যেন জমাট রক্ত? নাকি মাঠ ভেসে যাওয়া সর্ষে ফুল?
এই আয়না! ওই দৃশ্যপট! এই সড়ক! আর, ওই দরজা!
নীলগাইয়ের খুরে খুরে উৎপাটিত নক্ষত্র থেকে অগ্নিকণা
এখন আমার সর্বাঙ্গে। কালের আয়নায় আমার চিত্রিত শরীর।
উৎসুক দুটি চোখ, ত্বরিত আমার চলা, পায়ের নিচে পাথর—
আমি তো পৌঁছে যাবারই স্বপ্ন দেখেছি চিরকাল—দরজায়—
তোমারই দরজায়—এখন বৃষ্টিভেজা, শ্রাবণের তুলিতে তার
পাল্লার কাঠে সজল পুষ্পের ছবি ফুটছে একটির পর একটি—
এখনই তো! বৃষ্টিমাথায় দাঁড়িয়ে আছি—খোলো! খুলবে না?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৩, ২০১১
নিঃসঙ্গ কবি, নির্জন রেস্তোরাঁ
মাথার ভেতরে লেখা। অদূরে রেস্তোরাঁ।
আষাঢ় সেজেছে খুব মেঘে মেঘে-মনে সে করাবে
বিরহ বিপন্ন দিন-রাস্তাঘাট আদ্যোপান্ত খোঁড়া।
মাটির পাহাড়গুলো কতদিনে কে জানে সরাবে!
এরই মধ্যে পথ করে নিতে হবে আজ।
অপেক্ষায় কবিতা ও কফি।
হঠাৎ বৃষ্টির শুরু, ধমকাল বাজ।
পিছলে পা পড়ে গেল কবি।
সমস্ত শরীরে কাদা। এভাবে কি যাওয়া যেতে পারে?
বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে কেটে যায় কাল।
তবুও কি প্রেম কিছু ছাড়ে?
বিরহেও রয়েছে বহাল!
যদিও পিছল পথ, জামা কাদা লেপা।
হেঁটে চলো, হেঁটে চলো, দাঁড়িয়ে থেকো না।
সময় যতই হোক বিরুদ্ধ বা খেপা-
কবিতাকে ঠেকিয়ে রেখো না।
কবিতা কি থেমে থাকবার!
দুর্গতির একশেষ, খাতা তবু শক্ত হাতে ধরা।
হাতছানি দেয় কফি, আলো রেস্তোরাঁর,
দুধের বদলে ্নৃতি, কালো কফি, শব্দের শর্করা ু
২
বৃষ্টিভেজা গন্ধ ছড়ায় ফুলদানিতে ফুল।
ঘটিয়ে দেয় ইন্দ্রজাল রাতের রেস্তোরাঁয়।
একলা বুকে আছড়ে পড়ে ও কার খোলা চুল।
আষাঢ় এলে পদ্মা পাগল-পেলেই ভূমি খায়!
আগুন ওঠে দপদপিয়ে, লাফাতে চায় খাড়া-
ভোলা তো খুব সহজ নয় চিরে ফেলার ধাঁচ।
অতীতও নয় গেছেন কবি নক্ষত্রের পাড়া,
সেদিন কবি জেনেছিলেন স্বর্গীয় তার আঁচ।
ফুলের সাথে চুলের গন্ধ এখন একাকার।
এখন শুধু গন্ধটুকুই-এবং অন্ধকার ু
৩
কফির গরম গন্ধ। পেয়ালায় আঁকা দুটি ফুল
দীর্ঘ দুটি বৃন্তে তারা পরস্পর জড়িয়ে রয়েছে।
কত দীর্ঘদিন কবি রেস্তোরাঁয় এসেছে ও
একাকী সহেছে
বিরহ বিচ্ছেদ তার। আষাঢ়ের বৃষ্টিপাত হয়েছে তুমুল।
কবিতার খাতাটি পাশেই।
রেস্তোরাঁয় একা কবি চুমুকে চুমুকে
পান করে চলে কফি।
পৃথিবী বিপুল আর লেখার বিষয় তার
হতে পারে সবই।
কিন্তু আজ সেই মুখ-একটি সে মুখ ছাড়া
আর কিছু নেই।