কথায় কথায় জানা গেল এখানে এই শ্যাওড়াতলায় প্রতি বছর অম্বুবাচীতে একটা প্রকাণ্ড মহোৎসব হয়। যতলোক এখানে মানসিক করে তারা আসে। সকলের দেওয়া চাল ডাল তরকারিতে সারা দিনরাত অন্মমচ্ছব হয়। সমস্ত দিন চলে হাপু গান, শব্দ গান, ধুয়েজারী গান। সারারাত বসে ফকিরি গানের আসর। কীসের এত জনপ্রিয়তা? আহাদের কার্যকলাপ কেমন ছিল। আহাদ শাহ কি বাউল না দরবেশ?
এবারে ওয়াসেফ আলী বিশদ হলেন: ‘না বাবু, তিনি বাউল ছিলেন না। ছিলেন সুফিফকির। তাঁর জীবনকথা আমি যা জানি বলতে পারি।’
: বলুন তো৷
: পাশেই রানাবন্দ গাঁয়ে তাঁর জন্ম। বাবার নাম মাদারী, মার নাম অমেত্য। খুব গরিব মানুষ। পর পর সাতটা মেয়ে-সন্তান জন্মাতে সোয়ামী স্ত্রী আল্লার কাছে দোয়া মাঙলেন একটি পুত্র-সন্তানের জন্যে। মানসা করলেন সেই ছেলে জন্মালে তাকে আল্লার নামে উৎসর্গ করবেন। আল্লার ইচ্ছায় মানসা পূরণ হল। পুত্র-সন্তানের নাম রাখলেন আহাদ।
: আহাদ কথার মানে কী?
: আরবি ওয়াহেদুন শব্দ মানে এক। তার থেকেই আহাদ। যা হোক গরিব সংসারের অভাবী সন্তান আহাদ। পরের বাড়িতে রাখালি করতে লাগল। তবে আহাদ ছিলেন ছোট থেকেই বিনয়ী ধর্মভীরু উদাস স্বভাবের। তার পরে বয়স যখন আন্দাজ পনেরো-ষোলো তখন চন্দ্রকান্ত পরামানিকের বাড়ি কিনির কাজে লাগলেন।
আমি জানতে চাইলাম রাখালি আর কিষানিতে তফাত কী?
ওয়াসেফ আলী বললেন: ‘শহুরে মানুষ আপনারা বাবু। আমাদের গ্রামদেশে চাষবাস গোরুচরানো ছোটদের বলে রাখল আর বয়স্ক রাখালদের বলে কৃষাণ। তা ওই কিষানি করতে করতে আহাদ খবর পেলেন লোকমুখে যে বালিউড়ো-ভিটের গাঁয়ে আছেন এক পীর। বাস। সারাদিন কিষানি করেন আর সন্ধ্যা থেকে চলে যান পীরগুরুর কাছে। এদিকে বাবা মা জোর করে আহাদের বিয়ে দিলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে বাবা-মার ইন্তেকাল হল, সহধর্মিণীও গেলেন সর্পাঘাতে। সব বন্ধন গেল ঘুচে। আমার গুরু তখন এই শ্যাওড়াতলায় এসে আসন গাড়লেন, আশ্রম বানালেন। সারাজীবন কোথাও যাননি আর।
আমি বললাম: ‘প্রথম যেদিন শ্যাওড়াতলায় এলেন সেদিন থেকে আর কোনওদিন কোথাও যাননি এ কি আপনার শোনা কথা?’
: ছোটবেলা থেকে কথাটা শুনেছি, তা ছাড়া যতদিন জীবিত ছিলেন আমি তো স্বচক্ষে কোথাও যেতে দেখিনি। আর একটা আশ্চর্য জিনিস আমরা তাঁর শিষ্যরা দেখেছি। তাঁকে কেউ কখনও স্নান করতে, খেতে, বসন পালটাতে বা পায়খানা প্রস্রাব করতে যেতে দেখিনি। চোপর দিনরাত থেকেও লক্ষ রেখেছি। এমনকী… কথাটা কি বিশ্বাস করবেন?
: বলুন বলুন। শুনতে খুব ভাল লাগছে।
: আমার নিজের চোখে দেখা সেই বাংলা ১৩৪৫ সালে যেবার বন্যে হয়ে সব দিগর ডুবে গেল তখনও তিনি ওই গাছতলা পরিত্যাগ করেননি। চারিদিকে জল থই থই করছে। তার মাঝখানে তিনি কোমরে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে বসে থাকলেন। শিষ্যরা একখানা কলার মাড় তৈরি করে তাঁকে উদ্ধার করতে এলে তিনি বললেন— ‘দয়াল আমারে ভাসতে দিয়েছেন। তাই ভাসছি। তোমরা বাড়ি যাও।’
সম্রমে হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন ওয়াসেফ সেই বিদেহী ঐশীপুরুষের সম্মানে। তারপর বিগলিত স্বরে বললেন: ‘মহামান্যমান মানুষ ছিলেন তিনি। বাক্সিদ্ধ। যা বলতেন তাই হত। যে যা আন্তরিকভাবে মানসা করত ফলে যেত। তাঁর থানে এখনও হত্যে দিলে রোগ সারে। দেখুন কতজন পড়ে আছে।’
সত্যিই তাই। আহাদের বেদীর সামনে অনেক নারী-পুরুষ সাষ্টাঙ্গে পড়ে আছে। এর কি সবটাই মিথ না সত্যি কে বলবে? শান্ত ছায়াসুনিবিড় সেই আশ্রমের স্নিগ্ধ পরিবেশে খুব বড় নাস্তিকের মনেও দ্বিধা আসে। আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত পঙ্গু মেয়ের করুণ মুখ। দুর্বল মনকে শক্ত করে শেষ তৃণাশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলি: আপনি নিজে দেখেছেন কাউকে সারতে? নাম বলবেন তার?
‘বাবুর সন্দ কাটে নি’, ওয়াসেফ হেসে বলেন, ‘তা হলে আপনাকে দুবরাজের বিত্তান্ত বলতেই হয়। শোনেন। দুবরাজ ছিলেন আমার গুরুর প্রথম শিষ্যা। তাঁকে আমি দেখেছি অম্বুবাচীর ঘি-খিচুড়ির জন্যে ঘি নিতে আসতে।’
: দুবরাজের বাড়ি কোথায় ছিল?
: ওই বড় আন্দুলের কাছে নূতনগ্রাম-কেশবপোঁতায় ছিল তেনার ভিটে। খুব অল্প বয়সে বালিউড়ো-ভিটের গাঁয়ে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু শরীরে ঢোকে কুষ্ঠ ব্যাধি। সর্বাঙ্গ খসে পড়তে থাকে। সোয়ামীকে আবার বিয়ে করতে বলে চলে আসেন শ্যাওড়াতলার ফকিরের আস্তানায়। মাঝরাতে তার কান্না শুনে ছুটে আসেন গুরু। জিজ্ঞেস করেন ‘কে তুমি মা?’ সব শুনে বলেন ‘তাঁকে ডাকো যিনি দিলেন এই কালব্যাধি।’
: সত্যিই দুবরাজের কুষ্ঠ সেরে গেল?
: একদম সেরে গেল। আমার নিজের দেখা। এ আশ্রমে সবাই তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকত। এই তো সেদিন মারা গেলেন জননী। হ্যাঁ, সেও এক আশ্চর্য! আহাদ গেলেন ১৩৫৬ সনের ১০ই মাঘ আর দুবরাজ মা মাটি নিলেন ঠিক একবছর পরে ওই ১০ই মাঘ তারিখেই। আশ্চর্য নয়?
আশ্চর্য তো অনেক কিছুই। আণবিক যুগের বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশলের মধ্যে আমাদের দেশের লৌকিক দেবীর পূজার ঘটা কিছুই কমেনি। বাউল ফকির দরবেশ গোঁসাইদের বার্ষিক মচ্ছবেও কিছুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। প্রতি গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুললেও দেখা যাবে একই রমরমায় চৈত্র মাসে শেতলা পুজো হচ্ছে, শ্রাবণে হচ্ছে মনসা পুজো। তফাতের মধ্যে কেবল ঝাঁপান গানের বদলে মাইকের তারস্বর চিৎকার আর মেলার নানারকম বিক্রয় দ্রব্যের মাঝখানে লাল শালু মোড়া একখানা বামপন্থী গ্রন্থবিপণি। গ্রাম্য দেবদেবী পুজোয় আরেকটা নতুনত্বের কথা বলেছিলেন ব্ৰহ্মাণীতলার সুদেব সেনশর্মা। বলেছিলেন—‘চিরকাল দেখেছি মশায় আমাদের এই মনসা পুজোয় ভোজ দেওয়া হয় পাকা কাঁঠালের কোয়া দিয়ে। তবে আজকাল মা মনসার মুখ বদল হচ্ছে। তিনি খাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের বাম্পার ক্রপ আনারস আর গঙ্গাসাগরের তরমুজ।’ এও কি কম আশ্চর্য?