আরে ওই মানুষ-কাটা কল উঠেছে ভাই
তোরা কে দামড়া হবি আয়।
দামড়া করার হেকিম আছে পলাশীপাড়ায়।’
যেন সপাং করে চাবুক পড়ল মুখে। জ্যৈষ্ঠের সেই আতপ্ত বেলায় আমি লজ্জায় মুখ নিচু করলাম।
*
মানুষের জীবনে কোন কারণে যে কার সংসর্গ ঘটে তা কে বলতে পারে? আমার নিজের যে জড়বুদ্ধি মেয়েটি আছে তাকে সুস্থ করবার জন্যে একসময় মরিয়া হয়ে কী না করেছি, কোথায় না গেছি। কলকাতার সবচেয়ে ভিজিটঅলা প্রথম শ্রেণীর স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ থেকে তৃতীয় শ্রেণীর গ্রাম্য হেকিম পর্যন্ত ধাওয়া করেছি। সেবার আমাদের শহরে একজন বাক্সিদ্ধ ফকির এসেছিল। ও-সবে একদম বিশ্বাস করি না। তবু স্ত্রীর অনুনয়ে আর প্রতিবন্ধী সন্তানের করুণ মর্মান্তিক মুখখানা দেখে ফকিরের কাছে না গিয়েও পারিনি। এ সব জায়গায় গেলে মানুষের অসহায়তা আর আধিব্যাধির দারুণ বিস্তার দেখলে চমকে যেতে হয়। ফকিরকে ঘিরে অন্তত শ’খানেক পুরুষ-নারীর ভিড়। বেশির ভাগই বাপ মা। সন্তানের আরোগ্যের প্রার্থনা তাদের। কী সজল তাদের ভাষা, কী সকাতর আবেদন! ‘বাবা, আমার ল্যাংড়া ছেলেটা হাঁটবে তো?’ ‘বাবা, আমার মেয়ের বাক্শক্তি দাও দোহাই’, ‘বাবা আমার ছেলেটার মাথা আর কি ভাল হবে না?’ ‘আমার মেয়ের মৃগীনাড়া কি সারবে না? ও বাবা।’
ফকির উদাসভঙ্গিতে বলেন: ‘তাঁর ইচ্ছেয় জগৎ চলে। আমি কী করতে পারি? সবই তাঁর নিজের হেকমৎ। আমি তাঁর নামে ওষুদ দিই। সারার হয় সারবে। তাঁর নাম কর। তাঁকে ভাবো।’
ওই প্রচণ্ড ভিড়ে আমি কী বলব? কোলে আমার নির্বোধ মেয়ে আপন মনে দোল খাচ্ছে। নেহাৎ কৃপা হল, ফকির তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন: ‘ফলটা কার? আপনার নিজের?’
যেন চমকে গেলাম। ফল? ফল শব্দের এমন ব্যঞ্জনা কখনও ভাবিনি। সন্তান কিনা ফল। কর্মফলও কি? সায় দিয়ে ঘাড় নাড়তে বললেন: ‘ছেলেটার কী রোগ?’
: ছেলে নয়, মেয়ে।
‘যে ছেলে সেই মেয়ে’ ফকির হাসলেন, ‘সব তাঁর সৃষ্টি। কেবল ছাঁচ আলাদা। কর্ম আলাদা। ভগমান ওকে বোধ দেয় নি। তাই না? আমার কাছে কিছু হবে না। তবে রানাবন্দের শ্যাওড়াতলা চেনেন? সেখানে আহাদ ফকিরের থান আছে। ভক্তি ভরে হত্যে দিলে এ সব রুগি ভাল হয়। আমি নিজে জানি।’
রানাবন্দ তো খুব দূরে নয়। আমাদের শহর থেকে সোজা বাস যায় সেখানে চাপড়া হয়ে। অসুখ বিসুখের জন্যে হত্যে না হয় পরে দেওয়া যাবে, আপাতত জায়গাটা দেখেই আসা যাক, এই মনে করে একদিন সকালে রওনা হওয়া গেল। পথে যেতে যেতে যাত্রীরাই অনেকটা জানিয়ে দিল। খুব নাকি জাগ্রত থান। ‘আহাদ ফকিরের নাম এ দিগরে কে না জানে বলুন? কার না মানসা পূরণ হয়নি কহেন?’ বললেন একজন। চাপড়া বি. ডি. ও অফিসের কর্মচারী যুবকটি পাশ থেকে বললেন: ‘আহাদ নামটা শোনা শোনা লাগছে যেন? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই একজন ফকির, যাকে মার্ডার করেছিল কারা, তাই না?’
মার্ডার? ফকির হত্যা? আমি নড়েচড়ে বসি।
রানাবন্দে এসে বাস থামল। এখানেই বাস যাত্রা শেষ। এখান থেকে ছোট একটা নদী পেরিয়ে ওপারে শ্যাওড়াতলা। পৌঁছতে পৌছতে বেলা দশটা। একটা নির্জন জায়গা, গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা। ছোট দু-একটা চালা, একটা বেদী। এখানেই আহাদ ফকির বেশির ভাগ বসতেন।
‘তবে বসতেন যখন তখন দু পায়ের পাতা হাত দিয়ে ঢেকে রাখতেন’, বললেন এক বৃদ্ধ ভক্ত।
: কেন? কেন?
: যাতে কোনও ভক্ত তাঁর পা ছুঁতে না পারে। প্রণামে তাঁর বড় আপত্তি ছিল।
: আপনি জানলেন কী করে?
: কী আশ্চর্য! আমি যে তাঁকে স্বচক্ষে ওই বেদীতে বসতে দেখেছি। এই আপনাকে যেমন দেখছি।
একজন এগিয়ে এসে বলল: ‘আহাদসোনাকে যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন তাঁদের মধ্যে একজন ছামাদ আলী আরেকজন ওয়াছেফ আলী। ইনি ওয়াছেফ সাহেব।’
আমি অভিবাদন করে বলি: ‘আহাদ ফকির কি খুব পুরনো কালের নন?’
: খুব পুরনো কই আর? বাংলা ১৩৬৫ সনের ১০ই মাঘ তাঁর ইন্তেকাল হয়। তার মানে তেত্রিশ বছর আগে। আমি তখন জোয়ান।
এই ক বছরের মধ্যে কিংবদন্তি? খুব বড় জাগ্রত ফকির ছিলেন বোধহয়। কী আশ্চর্য, আহাদ সম্পর্কে কিছুই জানি না যে! কী ভাবে জানা যায়? ওয়াসেফ আলীকেই ধরতে হবে ভাবছি, এমন সময় বেদীর কাছে বসে গৌরকান্তি এক গায়ক গান ধরল। একজন আমার কানে কানে জানান দিল, ‘বাবু এ গাহক খুব নামী। এর নাম জহরালী। আমাদের পদ্মমালা-রানাবন্দের একেবারে একচেটিয়া গাহক।’ খোলা গলায় আন্তরিক সুর উঠল:
ঝকমারি করেছি আমি প্রেম করে কালার
হার হয়েছে বুড়ো মিনসে আমার গলার।
নবীন ছোকরা আমার স্বামী কোনওমতে নাইকো কমি
বুড়োর জন্য ছাড়লাম আমি অষ্ট অলংকার।
বুড়োর সঙ্গে প্রেম করে দিবানিশি নয়ন ঝরে
একবার এনে দেখাও তারে জুড়াক জীবন আমার।
দেখ দেখি সই আগবেড়ে আমার বুড়ো আসছে কতদূরে
আমি থাকতে আর পারি নে ঘরে চেয়ে আছি আশায় তার।
হে কালী দয়াল আমার বুড়োকে বেখো যত্ন করে
আমায় যেতে যেন না হয় ফিরি মুর্শিদ গো
সেই নবীন ছোকরার ঘরে॥
এমন অদ্ভুত বৈষ্ণব বিশ্বাসের গান কখনও শুনিনি। এখানে কালা মানে যদি হন কৃষ্ণ তা হলে সমস্ত গানে তাকে বুড়ো বলাটা খুব নতুন সন্দেহ নেই। গানটি সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করতে ওয়াসেফ বললেন—‘এ গানখানা আমাদের গুরু অর্থাৎ মহামান্য আহাদ শাহ প্রায়ই গাইতেন। তাঁর খুব পছন্দ ছিল গানখানা। আজ্ঞে না, কবে লিখা জানি না সঠিক।