আমি বললাম: এর কারণ ওদের চেনাজানা জগতের পরিধি তো খুব ছোট। জীবনের চাপে রুজির ধান্দায় তো আরও ছোট হয়ে যায় দিনে দিনে। এ সব গানে তাদের ব্যাপ্ত জীবনের স্মৃতি ধরা আছে। আমরা যেমন বাপ-ঠাকুর্দার আমলের সমৃদ্ধির খবর জানতে ভালবাসি এও তেমনি, নয় কি?
: অনেকটাই হয়তো তাই। কিন্তু গ্রামীণ জীবনের আয়োজন শহরের চেয়ে অনেক বড় মাপে। তাদের কৌতুহল সবটা জানবার। যেমন শহরের মানুষ জানে ধান থেকে চাল হয়, ব্যাস। গ্রামের মানুষ প্রথমে ধানের বিছন নিয়ে ভাবে, তারপর জমি তৈরি, সার দেওয়া, ধানের মাদা তৈরি করা, তারপরে রোয়া, তারপরে ধানের ফলন, ধান পাকা, তাকে তুলে এনে গোলাজাত করা, তাকে সেদ্ধ করা, ভানা পর্যন্ত সবটা জানে। সব কটা স্তর তাদের কাছে সমান জরুরি। এর সঙ্গে আছে যন্তরপাতির ভূমিকা। লাঙল বিদে মই হেঁসো ঢেঁকি চালি সবকিছু বিষয়ে থাকতে হয় সতর্ক। যত্ন নিতে হয় বলদজোড়ার। তার খাদ্যের জন্যে ধানের খড় মজুত রাখতে হয়। বোধহয় গ্রামের গানে সেইজন্যে এত ডিটেইলস থাকে।
: একেই কি বলে অ্যাবানডেন্স? যাক গে, এবার শোনা যাক পাখির গান।
ততক্ষণে দোয়াআলি গান শেষ করে বিড়ি ধরিয়েছে। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এবারে ধরল খুব লম্বা তান মেরে সুলতান:
আরে আরে আরে রে রে রে—
ফাঁদ না এড়ালে পাখি যাবি মরে রে
বিঘোরে রবি পড়ে।
আউল পাখি টিটি শালিক দোয়েল কোয়েল টাকসোনা
কালিময়না কাকাতুয়া ভীমরাজ টিয়ে চন্দনা।
পায়রা ঘু ঘু কাদাখোঁচা
হট্টিটি আর পাছানাচা।
ওই যে হলদে চড়ুই হাঁড়িচাঁচা ফাঁদেতে নেবে ধরে ॥
আমি সন্তোষকে বললাম, দেখলে তো গ্রাম্য গীতিকারের চিন্তার মৌলিকতা। পাখি সম্পর্কে গান লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ল, ফাঁদ এড়াতে না পারলে পাখি বেঘোরে মরে তা হলে পাখিদের বাঁচার প্রথম বাধা মানুষের তৈরি-করা ফঁদ। যাক, এবারে গানের অন্য অংশ:
চিল ঠোক্কর রঙ্গিকাক হরমতী আর বাজপাখি
পাখিতে পাখি শিকার করে
আমি তা স্বচক্ষে দেখি।
সন্তোষ বললে, এবারে দেখুন আরেক কনট্রাডিকশন। পাখিতেই পাখি শিকার করে। বলতে গেলে এটা জীবজগতেরই কনট্রাডিকশন। মানুষই তো মানুষ মারে নানাভাবে। কিন্তু থাক ও সব কচকচি। আগে গানটা শুনি। ভাল লাগছে বেশ। বলুন?
হুদহুদ আর পরিওল শরবনে বাস সেজারু
শালবনে এক পাখি আছে নামটি তার শালতরু।
বউ কথা কও কোকিল ওই
শব্দ শুনে সুখী হই।
ফুলের মধু খায় যে সদাই কুচপাখি বলে তারে।
বাঁশপাতা মাছরাঙা পাখি পানকৌড়ি জলপিপি
উড়োবক ছিঁয়াছুড় কিস্তে চোরা এরাবগা মানিকজোড়া
সন্তোষ বলল: আপনি অ্যাবানডেন্সের কথা বলছিলেন না? নেচারস ওন অ্যাবানডেন্স। এখন শুধু গ্রামেই পাবেন এ সব। কত সব পাখি আমাদের দেশে। আর কি আছে এরকম পাখি? প্রায় একশো বছর আগে আর্জান শা এ গান লিখেছিলেন। মনে রাখবেন তখনও দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। বাতাস বিশুদ্ধ ছিল। জমি আর জলা এত হতশ্রী হয়নি। গাছে পাকা ফল থাকত। পাখিরা তো এ সবেই বাঁচে।
সুলতান গায় নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে:
মতিরাবাস বুলবুলি গগন আর ভেটকুল্লি
সংসারের শুক পাখি তুইথুলি আর মুইথুলি।
আবার কাঠঠোকরা কুকো পাখি
ময়ূর চড়াই আর বাবুই
আবাবিল করবটে ফিঙে গড়ুল খড়খণ্ডে ধুলো চটুই।
লালমোহন আর ধীরাজ পাখি
হংস সরাল চকাচকী
বেঙাবেঙি ধনেশ পাখির হাড় দেয় কোমরে ॥
গান এগিয়ে চলে আপন গতিতে। আমি ভাবলাম এ সব পাখি আর সত্যিই কি আছে? অকৃত্রিমভাবে? সন্তোষ বলল, ‘কী ভাবছেন?’
বললাম: কী জানি কেন আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কালোসায়েবকে। এ সব পাখির মধ্যে আই. আর. এইট কোনও পাখি ঢুকে পড়েনি তো?
সন্তোষ হো হো করে হেসে উঠল।
ইতিমধ্যে গানের আসর আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে লাগল। বেলাও বাড়ছে। তা ছাড়া গান শুনলেই তো পেট ভরবে না। কাজের মানুষগুলো তাই যে যার কাজে গেল। কেবল একজন আমার কাছে এসে খুব নিচুস্বরে বলল, ‘বাবু, আপনাদের কথা সব শুনেছি। তাই বলছি এ গানও কিন্তুক খাঁটি গাঁয়ের মানুষের মনের গান নয়। সে গান শুনতে হলে আপনাকে একজনের কাছে যেতে হবে ও পাড়ায়। যাবেন?’
সন্তোষকে রেখে আমি একাই গেলাম। পৌঁছানো গেল একটা মেটে দাওয়ায়। সেখানে একজন মাঝবয়েসী খুব নিস্পৃহমুখে বসে আছে যেন কত তিতিবিরক্ত। তবে আমার সঙ্গীকে (যান নাম অরুণ) দেখে তার মুখে একটা চাপা হাসি খেলে গেল। অরুণ বলল: ‘চাঁদুদা, এ ভদ্রলোক খাঁটি গ্রামের গান খুঁজছেন। দোয়াআলি ওঁকে সেই কবেকার ফল পাখি লোহার গান শোনাচ্ছিল। আমি ওঁকে ধরে আনলাম। এখনকার একটা সত্যিকারের গ্রামের গান ওঁকে শুনিয়ে দেবেন নাকি?’
চাঁদুদা বললেন: ‘সত্যিমিথ্যে বলতে পারব না বাবু। আমাদের মামার বাড়ির অঞ্চলে অর্থাৎ নলদা, টুঙ্গী, শব্দনগর, পলাশীপাড়া, সায়েবনগরে চোত মাসের সংক্রান্তিতে ছেলেরা ‘বোলান’ বলে একরকম গান গায়। হালফিলের ঘটনা নিয়ে তাতে থাকে ‘রং পাঁচালি’ বলে একরকম জিনিস সেরকম একটা নমুনা শুনবেন কি? তাতে কিন্তু কোনও জ্ঞানের কথা নেই। তবে সত্যি কথা আছে। শুনুন তা হলে।’
চাঁদুদা এর পর সোজা তাকালেন আমার দিকে। বললেন: ‘গবরমেন্ট সব গ্রামে গ্রামে হেলথ সেন্টার করেছে জানেন তো? সেখানে অপারেশান হয়, যাতে মানুষ আর না জন্মায়। তাই নিয়ে একটা গান হল এইরকম: