সন্তোষ বলল, ‘তোমাদের এই কানা বক আর শুকনো নদীর কাজিয়া আমি শুনতে চাই না। দোয়া, তুমি মানুষের গানের পরে এবারে ফলের গান একটা শোনাও।’
‘সবই তো মানুষের গান আজ্ঞে,’ দোয়াআলি বলে, ‘ফল তো খোদা মানুষের জন্যই বানিয়েছে। নইলে ফলের আর মূল্য কী? তবে হাঁ খোদর সবচেয়ে হেকমতি এই মানুষরূপ ফল বানানোতেই। শুনুন তবে—
গাছে ফল ধরালে বারএলাহি কুদরত তাহারি।
প্রথমে দুই গাছেতে এক ফল ধরায়
দ্যাখো না মক্কর ভাই–
সেই ফলের খাতিরেতে নানা প্রকার ফল তৈয়ার॥
এই পর্যন্ত গেয়ে দোয়াআলি বলল: সুলতান আছ নাকি? বাবুকে গানটার মানে বলে দাও দিনি।
সুলতান ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে বলল: বাবু, বারএলাহি হলেন কিনা আল্লা। কুদরত মানে ক্ষ্যামতা। দুই গাছ মানে আদম আর হেবা। মক্কর মানে কারিকুরি। আর ফল মানে মানুষ।
সন্তোষ বলল: তার মানে আল্লা তাঁর কারিকুরি আর সৃষ্টি ক্ষমতায় প্রথমে আদম আর হেবার সৃষ্টি করলেন। সেই দুজন হতে জন্মাল মানুষ। আর সেই মানুষের জন্য নানাপ্রকার ফল তৈরি হল। কেমন কিনা?
‘যথার্থ, যথার্থ’ দোয়াআলি বলে উঠল সোচ্ছ্বাসে, ‘শিক্ষিত লোকের জ্ঞানবুদ্ধি একেবারে পরিষ্কার। যাক, এবারে বাকিটুকু শুনুন ধীরে ধীরে। সুলতান তুমি বাবুর কাছে-ভিতে থাকো। মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেব। শোনেন—
ধান্য গম আর কলাই তিলে
খুশি ভাই হই নারকেলে
আবার কতজনার পুলক তালে
আছে বেগুন ঝিঙের তরকারি।
পটল করলা আর টোপা কুল
টক রাঁধার আছে তেঁতুল
টকমিষ্টি লেবু মাকুল
সস্তার ডাল খেঁসারি।
মরিচ ধনে মৌরি জিরে
এই কয় ফলের মসলা হয়
কলা আইড়ি লাউ লালিম
শশা পেঁপে বেঁধে খায়।
আবার রাই সরষে তিসি গাঁজা
এই চারফলে তেল তৈয়ার।
আমার সামনে খুলে যায় এক স্পন্দমান মানুষের জগৎ। জীবন রস-সম্পৃক্ত এক ভোজন সচেতন সমাজের ছক। দোয়াআলি অবশ্য থেমে নেই। অনাবিল তার কণ্ঠ গেয়ে যাচ্ছে:
কদবেল আর খিরো জামির
পানিফল আর করঞ্চা
চালতা খেজুর খরমুজ ডালিম
লিচুর চাই খোসাবাছা।
কদু ভুরো গ্যামা মেরো
শেয়াল-ল্যাজা আদরকি।
মিহির দানা জাজির ভুট্টা
চেঁপের ফল হয় মোটামোটা।
কেলেজিরে হলুদ মেথি
জাম পোস্ত তোকমারি।
কাঁকরোল খায় ভর্তা করে
বৈঁচি ফল খায় যুবান তরে
খায় হরিতকী পানের পরে
চন্দনী হজমিকারী।
গান হলেই চলে। শ্রোতারা যতটা আবিষ্ট, দোয়াআলিও ততটা। কিন্তু আমার মনে হল এখানে আমার ভূমিকা কী? এই গ্রামীণ জগতে কি আমি খুবই বেমানান নই? সত্যিই তো এর মধ্যে কত ফল শস্যের নাম আমি জানি না। আমাদের শহুরে জীবন প্রকৃতই কত সম্বৃত কত সীমায়িত। আলাদা করে সব শস্য মনে রাখা বা তার ব্যবহারবিধি সম্পর্কে আমাদের চেতনা কি খুব সজাগ?
এর মধ্যে এক সময়ে ফলের গান শেষ হয়ে শুরু হয়ে গেছে লোহার গান, সেও কি কম বিচিত্র? সে গানের গোড়াতেই এক ধাক্কা:
বাঁশের দ্রব্য গঠন যত লোহা ভিন্ন নয়।
লোহার বাঁশ না কাটিলে
অমনি ঝাড়ে রয়।
সত্যিই এ কথাটা এমন করে কখনও ভাবিনি। লোহার প্রথম কাজ বাঁশ কাটা। সেই বাঁশ দিয়ে তবে খোড়ো চালের খুঁটি আর বাতা, গোরুর গাড়ির দেহ, মাচা, ছই। এমনই কত কী। দোয়াআলির গান লোহার হরেকরকম ব্যবহারকে বিশদ করে চলে:
লোহার গাছ কাটা দা কুড়লে
শাবল আর খোন্তার ফালে
চিচকে ছুঁচে নিড়েন কাচি
ডেড়ো কোদালে।
সুলতান পাশে দাঁড়িয়ে বলল: বাবুর বোধহয় বুঝতে একটু ধন্দ লাগছে। শোনেন তবে। চিচকে মানে পটল পোড়াবার শিক। গ্রামদেশে গরিব মানুষ তেল খেতে পায় না তাই পটল পুড়িয়ে খায় আজ্ঞে। কাচি মানে ধান বা গম কাটার যন্তর। এবারে শোনেন লোহার আরও কেরামতি—
সে হয় লাঙলের ফাল
পাসি আর গজাল।
বল্লম সড়কির ফলি বাঁশ বাটালি
উকো কেঁকো টেঁকো।
মাকু চাকু ছুরি বঁড়শি কাটারি।
সুলতান বলল: পাসি হল যেখানে লাঙলের ফাল আঁটা থাকে। কেঁকো হল মাছ মারার যন্তর। আবার শুনুন—
তুরপুন ঘুরপুন র্যাঁদা ঘিস্কাপ
নেহাই হাতুড়ি
বাউলহাতা কাজললতা
চোরের পায়ে বেড়ি
‘বাঃ বাঃ চমৎকার’ সন্তোষ বলে উঠল। ‘চোরের পায়ের বেড়ি পর্যন্ত? বাপ রে। কিন্তু বাউলহাতা কী গো? ওটা তো আমিও চিনলাম না’।
: বুঝলেন না? গাঁ-ঘরে বাউলহাতা দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করে। কিন্তু ওদিকে গান যে বয়ে যায়, শোনেন—
সন্না আর বাণ বন্দুক কামান
ছেকল বিদের কাঠি কড়ার বাঁট
হাঁসকল ডোমানি হুলোগুলো বিদে বাওলে
ভোমর বাদারি।
সুলতান বললে: কী বাবু, আবার ধন্দ লাগে নাকি? তবে বুঝে নেন। হুলোগুলো থাকে ঢেঁকির মুগুরের মাথায়। ভোমর বলে মুচিরা যা দিয়ে জুতো সেলাই করে। আর বাদারি দিয়ে চামড়া ছেলে। নাও গো দোয়াআলি এবারে লোহার গান সাঙ্গ করো দিনি। এখনও পাখির গান বাকি। সেটা না হয় আমিই গাইব খুনি।
লোহার হন্দরেতে পাথর গুঁড়ো হয়
নরসুন খরসুন ক্ষুর কাঁচিতে কাটে চুল
নেটকা সারা জলুই পেরেক
ছাতার শিক আর শূল।
জাহাজে টাঙায়ে নোঙর দরিয়াতে রয়।
সুলতান বললে; বাবু, নরসুন মানে নরুন। আর খরসুন দিয়ে ঘোড়ার গা আঁচড়ানো হয়। কিন্তু এ গান এখন চলবে অনেকক্ষণ। আপনাদের এ গান ভাল লাগবে না।
আমি সন্তোষকে একপাশে ডেকে বললাম: তুমি এ সব গানে কী পাও? কোনও গভীর সংবাদ এ গানে কই?
সন্তোষ বলল: গ্রামীণ সমাজবদ্ধতা, বস্তুর ব্যবহার সম্পর্কে অভ্রান্ত জ্ঞান, ব্যাপক মানুষের প্রয়োজনের দিকটা কি খুব বাদ দেওয়া যায়। আপনি লক্ষ করেছেন যে আমাদের চেয়ে গ্রামের মানুষ গানটা অনেক বেশি এনজয় করছে। এর কারণ কী বলুন তো?