‘আর অদ্ভুত সব উদ্ভট গান’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কালোসাহেব বলেন।
‘উদ্ভট’ গান? আমি জিজ্ঞাসু হই।
‘হ্যাঁ, উদ্ভটই তো। শোনেননি? আচ্ছা দাঁড়ান, আমার হিসেবের খাতায় একটু টুকে রেখেছি খানিক। পেয়েছিলাম লালগোলার ট্রেনে এক টেরিকটন- বাউলের কাছে। এই, এই যে পেয়েছি। শুনুন গানের কথাগুলো:
মন যদি চড়বি রে সাইকেল।
আগে দে কোপনি এঁটে অকপটে সাচ্চা কর দেল।
ফুটপিনে দিয়ে পা
হপিং করে এগিয়ে যা,
পিনের পরে উঠে দাঁড়া
সামনে রাখ নজর কড়া
আগাগোড়া ঠিক রাখিস হ্যানডেল।
সিটের পরে বসে।
ব্যালান্স করবি কষে।
মূলমন্ত্রে কর প্যাডেল॥
কী বুঝলেন?’
: বুঝলাম যে এই গানটা হল টেরিকটন— বাউলের গাওয়া একখানা সাচ্চা আই, আর এইট গান, তাই তো?
একগাল হেসে বললেন কালোসায়েব, ‘অনেকটাই বলেছেন। তবু একটু বাকি। এ গানের লেখক কে? খোঁজ করলে দেখবেন ওটি রচনা কলকাতানিবাসী কোনও আই. আর এইট লোকগীতিকারের। সুর দিয়েছেন, “খ্যাপা” নামধারী কোনও সিনথেটিক ব্যক্তি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একখানা কোলাবোরোটিভ স্কিম যাকে বলে। তাহলেই বুঝছেন আপনার কাজটি বেশ কঠিন।’
: কেন কঠিন?
: কঠিন নয়? আপনাকে তো টেরিকটনের যুগে কটন খুঁজতে হবে। সে কি খুব সহজ?
রাতে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কোথা থেকে কোথায় না এসে পড়েছি। নিছক একটা শব্দের টানে খুলে গেল কত না জগৎ। ‘আনখা মেয়েছেলে’কথাটা টেনে নিয়ে গেল এক সহজিয়া আখড়ায়, সেটা নাকি আবার অ্যাবরশন সেন্টার। সেখান থেকে যদি বা পড়লাম সন্তোষের হাতে সে এনে ফেলল এক অদ্ভুত মানুষের কাছে। স্বচ্ছ চোখে যার কেবলই ধরা পড়ে সমাজ-কাঠামোর বিপ্রতীপ চেহারা আর ভণ্ডামি, স্ববিরোধ আর কৃত্রিমতা। আই. আর, এইট-কে এমন আশ্চর্য প্রতীক আর প্রতিমায় বাঁধা, এও কি কম অদ্ভুত? সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
হয়তো নতুন পরিবেশ বলে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছিল। সারা গা ঘামে জবজবে। উঠে বাড়ির বাগানে গিয়ে একটা আশশ্যাওড়া তুলে দাঁতন করছিলাম এমন সময় সন্তোষ এল। নির্মল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল: ‘কেমন ডেরা বলুন তো? কালোসায়েব আমাদের মানুষটা সোজা। শিরপ্যাঁচ নেই’। একটু থেমে বলল, ‘ভাল কথা। আপনি যে গ্রাম্য গান সংগ্রহ করেন কেমন গান সে সব? ধম্মে আমার ইন্টারেস্ট নেই। অন্য ধরনের গ্রাম্য গান আমার সন্ধানে আছে। নেবেন?’
‘সত্যি?’ আমি অবাক মানি। ‘আমি তো অনেকদিন থেকে অন্য গান খুঁজছি। আমি বিশ্বাস করি দেহতত্ত্ব, শব্দ-গান আর ফকিরি গানের বাইরে নিশ্চয়ই একটা অন্য গানের জগৎ আছে। কিন্তু কোথাও পাইনি। তোমার কাছে আছে? দেবে আমায়?’
সন্তোষ বলল, ‘আমার কাছে নেই, তবে আমার সন্ধানে আছে। যেতে হবে কড়েয়া গ্রামে। সাইকেল চড়তে পারেন? সেখানে এক অন্ধ গায়েন আছে। নাম দোয়াআলি। যদি কপাল ভাল থাকে তবে পেয়ে যেতেই পারি।’
আমি বললাম, ‘কেন? অন্ধ যাবে কোথায়?’
: ও তো বেশির ভাগ দিন সকালে বেরিয়ে যায় ভিক্ষেয়। বার্নিয়া, ধোপট এই-সব গ্রামে। ফেরে দিন গড়ালে, তারপরে খায়।
: সারাদিন ভিক্ষে করে তারপরে আবার রাঁধে?
না না, ওর বিবি আছে। সুরতন্নেছা। সে অন্ধ। আমরাই দুজনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। বেশ আছে। মাঝে মাঝে রাতে ওদের আস্তানায় থাকি, গান শুনি। সে সব গান দারুণ। একেবারে অন্য রকম। চলুন চলুন দেরি করব না।
খুব তাড়াতাড়ি চা জলখাবার খেয়ে কালোসায়েবের বাড়ির সকলের কাছে বিদায় নিয়ে কড়েয়ার পথ ধরলাম। জ্যৈষ্ঠের সকাল। তখনও বাতাস তাতেনি। কত কী ফুলের পাতার গন্ধমাতাল সকাল পেরিয়ে গল্পে গল্পে আমরা পৌঁছলাম দোয়াআলির বাড়ি মানে কুঁড়েঘরে। কপাল ভাল। অন্ধ বসেছিল দাওয়ায়। বলে উঠল, ‘পায়ের শব্দে মনে হচ্ছে সন্তোষ। ঠিক কি না? সঙ্গে কে?’
পরিচয়পর্ব মিটতে দোয়াআলি বললে, ‘বাবু আমি গরিব, বড্ড গরিব। তবু এয়েছেন যখন কিছু খান। কিছুই নেই আমার। আছে কখানা তালগাছ। কটা তালশাঁস খান। দাও গো বাবুদের কটা তালশাঁস।’ দোয়াআলির বিবি সুরত আমার সর্বাঙ্গে তার অন্ধ চোখের মায়া বুলিয়ে বলল, ‘বোসো বাবাসকল। একটু জিরোও। ও মানুষটা অমনিধারা চিরকাল শুধু তালশাঁস কাউরে দিতে আছে? সঙ্গে এট্টু বাতাসা সেবা করুন আজ্ঞে।’
বেলাও বাড়ে। টুকটুক করে দু-চারজন গাঁয়ের লোক জমে। ‘গানের গন্ধ পেয়েছে সব’ দোয়াআলি সগর্বে বলে। তারপরে একতারা কাঁধে তুলে গেয়ে ওঠে:
আরে তানা না তানা না না
ওরে মুষ্টি ভিক্ষে করে আমি খেতে পাই নে উদরপুরে।
ও মন লয়ে ঝুলি মনের খেদে বেড়াই লোকের দ্বারে দ্বারে।
বাড়ি বাড়ি হাঁটব কত
ভূত খাটুনি খাটব কত
রোদে পুড়ে মরব কত
মনের দুঃখ কই কারে।
আমার ঘরেতে বোষ্টমী আছে
পণ-কাঠা চাল চিবিয়ে মারে।
তিনি দেবী আমি দেবা
বলেন আমায় ঠাকুরবাবা
আমি করি ঠাকুরসেবা
শুনে বড়ই রাগ ধরে।
তিনি সদাই বলে ‘খাব’ ‘খাব’
কোথায় পাব খাওয়াই তারে?
গান শুনে সুরতন্নেছা কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে বললে, ‘সন্তোষ, তুমি এ গান বিশ্বেস করলে? আমি কোন সময়ে ‘খাব’ ‘খাব’ বলেছি। আমি পণ-কাঠা চাল চিবিয়ে মারি? পণ কাঠা চাল কোনওদিন চোখে দেখেছ ড্যাকরা কানা?’
দোয়াআলি হেসে বললে, ‘এ এক জ্ঞানছাড়া মাগীর পাল্লায় পড়েছি যাহোক। সন্তোষ, তুমি এ কোন এঁটুলি লাগিয়ে দিলে আমার আলাভোলা জীবনে। এর রসকষ নাই। গান বোঝে না। আরে কানী, এ গান কি আমার রচা? এ তো কুবির গোঁসাইয়ের রচনা।’