এতক্ষণ মুখ সুড়সুড় করছিল, শেষপর্যন্ত বলেই ফেললাম: ‘মানুষজন আপনার সহ্য হয় না কেন?’
হো হো করে খানিক হাসলেন উচ্চকণ্ঠে আপন মনে। তারপর বললেন: ‘মানুষজন আপনি দেখতে পান আর? কোথাও আছে? সব আই. আর. এইট ভ্যারাইটি।’
: আই, আর, এইট? সে তো একরকম ধানের নাম! তাই না?
: প্রথমে ধানের বীজ ছিল। তারপরে সবজির আই. আর. এইট বেরিয়েছে। সবশেষে এখন মানুষের আই. আর. এইট দেশ ছেয়ে গেছে। উচ্চ ফলনশীল। দেখতে ভাল, ভেতরে ঢুঁঢুঁ। বিস্বাদ। অড লুকিং ব্যাড কারেকটার্স। চারিদিকে থিক থিক করছে আই. আর. এইট মানুষ। দেখেননি?
আমি বললাম: নিশ্চয়ই দেখেছি কিন্তু বুঝিনি। আপনি বোঝেন কী করে?
: কেন, লক্ষণ দেখে! এই তো আমার পাশের বাড়ির ছোকরা, নামের খুব জোর, সন্দীপন। গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু একখানা দরখাস্ত লিখতে পারে না। কী বুঝবেন? আই. আর. এইট গ্র্যাজুয়েট। ও পাড়ার নন্দ গোঁসাইয়ের মেয়ে ‘সংগীত প্রভাকর’। কিন্তু গান গাইতে বলুন, হয় বলবে সঙ্গে গানের খাতা আনিনি কিংবা হারমোনিয়ম কই? আই. আর. এইট গায়িকা। ওই বাড়িতে থাকে সতীশ বিশ্বেসের ছেলে সুবল। মাস্টার। কিন্তু আদ্ধেক দিন ইস্কুল যায় না, কী না পার্টি করে। ছাত্ররা আড়ালে প্যাঁক দেয়। অঞ্চল প্রধানকে দেখুন— চোর। পুলিশ ডাকুন কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এসেই ঘুষ খাবে তারপরে এসে বলবে মিউচুয়াল করে নিন। সব আই. আর. এইট। মেকি। ভুয়ো। সাইপিয়ন মাছের মতো। আর কী সব ভাষা। আগে ইতর ছোটলোকেরা কথায় কথায় যেমন শকার-বকার করত এখন লেখাপড়া জানা ছেলেরা সেইরকম ব্যাড মাউথ করে। শোনেননি?
: ব্যাড মাউথ?
: হ্যাঁ। মানে মুখ খারাপ।
: এত সব আই. আর, এইটের ভিড়ে আপনি টিঁকবেন কী করে? তা ছাড়া নতুন ছেলেমেয়ে যদি সমাজের হাল না ধরে দেশ কী করে এগোবে?
: এই নিয়ে তুমুল তর্ক বাধে আমার সঙ্গে সন্তোষের। একেবারে বাইশ ক্যারেট সোনা ওই ছোকরা। খুব আশাবাদী। ও বলে, সমাজ পালটাবে, মানুষ নাকি বদলে যাবে। আমি তো উলটোটাই দেখি, পালটানোটা দেখি না। সন্তোষের মতো ছেলে আর কটা? গাঁয়ে ঘুরুন। সব প্রিন্টেড টেরিকটনের বুকচেরা হাওয়াই শার্ট, লুঙ্গি আর হাওয়াই চটি। এ দেশের এই হল ন্যাশনাল ড্রেস। যেমন কুচ্ছিত সমাজ তেমনি ছোকরাদের ড্রেস। কিন্তু একটানা তো বকেই যাচ্ছি। আপনার কথা তো কিছু জানলাম না। ধুতি পাঞ্জাবি পরে সভ্যসমাজে ঘুরে বেড়ান, আপনি তো মশাই সোনামুগের মতো দুর্লভ ভ্যারাইটি।
সোনামুগের উপমাটা বেশ নতুন। ব্যাখ্যা চাইলাম। বললেন এ দেশে সোনামুগের বীজ নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। আর ফলে না। ‘সোনামুগের ডাল খেয়েছেন? এক বাড়িতে রান্না হলে সারা পাড়ায় বাস ছুটত তার। কী করে আর খাবেন? দেশটা ঘোড়ামুগে ভরে গেল। তা আপনি তো শিক্ষকতা করেন, সেখানে আই. আর. এইট নেই? থাকলেও অবিশ্যি আপনি চিনবেন না। যাই হোক আমাদের পাশের গ্রামে একটা ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল হয়েছে, আশ্চর্য মশাই, যতদিন সায়েবরা ছিল তত দিন ইংলিশ মিডিয়াম ছিল না এত।’
: তা হলে হঠাৎ এত গজাল কেন? আপনার কী মত?
কালোসায়েব বললেন, ‘সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন আমন ধানের চেয়ে জয়া-রত্নার কাটতি বেশি। রুই মিরগেলের চেয়ে বেশি চলে সিলভারকাপ। ইংলিশ মিডিয়াম তো ক্রসব্রিড ভ্যারাইটি, তেলাপিয়ার মতো এখন খুব চলবে।’
চমৎকার ঝকঝকে কথার মাঝখানে কোথায় যেন নৈরাশ্যবাদ বোনা আছে ভদ্রলোকের। তাই বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্যে বললাম; ‘সবই তো আপনার খারাপ লাগে। কিন্তু আমি যে কাজটা করার জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরি সেগুলো কিন্তু জেনুয়িন। আপনি জানেন আমি কোন কাজে ব্যস্ত?’
: সে খুব জানি। সন্তোষের কাছে শুনেছি।
কালোসায়েবের ভঙ্গিতে কেমন একটা ঔদাসীন্য আর অবজ্ঞা আমার চোখ এড়াল না। তাই খুঁচিয়ে তুললাম প্রসঙ্গটাকে আবার নতুন করে। জিজ্ঞেস করলাম: ‘আমার কাজটাও তা হলে আপনার পছন্দসই নয়। সেটাও কি আই. আর. এইট?’
: কাজটা জেনুয়িন। আপনি মানুষটাও সোনামুগ। কিন্তু যে গান খুঁজছেন তাতে অনেক ভেজাল।
: সে কী? কেন?
: তা হলে একটু বিশদ করে বলি। বাউল বৈরাগীরা আগে ছিল সাধক ভক্ত। এখন হয়েছে ব্যবসাদার। পথে ঘাটে মেলায় ট্রেনে কারা বাউল গান করে দেখেছেন? সব সাজানো বাউল।
বেশ চমকদার কথা। হ্যাঁ, কথাটা ঠিকও বটে। সত্যি সত্যিই নকল বাউলও আছে বইকী। ঘোষপাড়ার মেলায় দেখেছি। সাঁইবাবার মতো চুল, গেরুয়া আলখাল্লা আর মাখন জিনের প্যারালাল পরা যুবক বাউল গাইছে। গান শেষ হতেই আলখাল্লা খুলে ব্যানলনের লাল গেঞ্জি পরে আসরের কোণে বসে গঞ্জিকা সেবন করতে লাগল। ঠিক ঠিক। আমি কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি আই. আর. এইট বাউল বোঝেন কী করে?’
: প্রথমে আলখাল্লা থেকে।
: কী রকম?
: কেন দেখেননি? গেরুয়া রঙের টেরিকটন বেরিয়েছে।
: সে কী?
: হ্যাঁ। পরখ করে দেখবেন। আই. আর, এইট বাউল সবসময় গেরুয়া টেরিকটনের আলখাল্লা পরে। তার মানে কী? জেল্লাদার, টেঁকসই, অ্যাট্রাকটিভ। একটা কথা শুনেছেন? আগে বলত, ‘মন না রাঙায়ে বসন রাঙালি যোগী।’ আমি কথাটাকে ঘুরিয়ে বলি কি জানেন? বলি, ‘বাউল না হয়ে বাউল সাজলি ভোগী।’ কী, কেমন বানিয়েছি?
আমি বললাম, ‘বাঃ, বেশ বানিয়েছেন তো। সত্যিই পথে ঘাটে মেলায় যে সব শৌখিন বাউল দেখি তাদের প্রধান কাজ হল ভিক্ষে করা আর সেইজন্যেই তাদের ওই রকম পোশাক।’