: আপনি কিছু করছেন না। কোনও প্রতিরোধ?
: তারই চেষ্টা চলছে। কঠিন। কঠিন কাজ। আপাতত একটা নাইট স্কুল খুলেছি। অনেক লোক শত্রুতা করে পেছনে লেগে গেছে এর মধ্যে। অঞ্চলপ্রধান বাধা দিচ্ছে। সেও তো গুরুঠাকুরের শিষ্য। কবে একদিন হয়তো আমায় গণধোলাই দিয়ে খতম করে আমার হাতে একটা পিস্তল ধরিয়ে দেবে। আপনারা খবরের কাগজে রসিয়ে পড়বেন: রাখালগাছি গ্রামে নদীর চরে সশস্ত্র যুবক গণধোলাইয়ে খতম।
ম্লান হাসি যুবকের মুখে। হঠাৎ বলল, ‘ভাল কথা। আপনি এই রাতে থাকবেন কোথা?’
: থেকে যাব কোথাও। অভ্যেস আছে।
: তা কি হয়? আমার ডেরা অবশ্য একটা আছে সেখানে থাকলে আপনার উটকো ঝামেলা হবে কাল সকালে। তার চেয়ে চলুন আপনাকে কালোসায়েবের বাড়ি নিয়ে যাই।
কালোসায়েব নামটা যত অদ্ভুত মানুষটা তার চেয়ে কম অদ্ভুত নয়। একটা মরা সোঁতার ওপরে বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো, তার ওপিঠে কালোসায়েবের বাড়ি। ভট ভট করে জেনারেটর চলছে। কালোসায়েবের বাড়ি আলোকিত। গ্রাম দেশে খুব অভিনব দৃশ্য বইকী! যুবক আমাকে কালোসায়েবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েই কেটে পড়ল ‘চলি দাদা, কাল সকালে আবার দেখা হবে।’
কালোসায়েব আসলে কালো নন, রীতিমতো গৌরবর্ণ শালপ্রাংশু পুরুষ। বয়স আন্দাজ ষাট বছর। খুবই অভিজাত ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা করে বসালেন একখানা সাবেকি ডিভানে। সুন্দর সাজানো ঘর, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, উনিশ শতকের রঙিন বিলিতি ছবি দেওয়ালে বাঁধানো, ঝাড়বাতির মধ্যে জেনারেটরের কল্যাণে ডুম জ্বলছে। চমৎকার। যেন উত্তর কলকাতার এক তস্য গলির সাবেক কলকাতাকে খুঁজে পাবার বিস্ময় আমার চোখে।
‘কালোসায়েব আমাকে বলে সব হিংসায়’ মানুষটি আমাকে বোঝাতে চান বিশদ করে, ‘আসলে আই হেট দিস ভিলেজ অ্যান্ড দোজ ভিলেজারস। দে আর ন্যারো মাইন্ডেড অ্যান্ড আনক্লিন। ওই সন্তোষ ছোকরা, যে আপনাকে আনল আর কী, ওর সঙ্গে আমার যেটুকু মেলামেশা, কথাবার্তা।’
: গ্রামে কি সবায়ের সঙ্গে মেলামেশা না করলে টেঁকা যায়? অত্যাচার করে না? ডাকাতি হয়নি?
: অ্যাটেমটেড বাট ফেলড। মশাই, আমার চার বোরের বন্দুক আছে তিনখানা। আমি, আমার গিন্নি আর আমার বউমা সব বন্দুকে ওস্তাদ। আমরা হলাম সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট ফ্যামিলি। দাঁড়ান সব আপনাকে দেখাই। কিন্তু সব আগে চা জলখাবার।
কালোসায়েব উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে রাখা এক স্বনির্মিত দেশজ মডেলের টেলিফোন তুলে বোতাম টিপে শুরু করলেন সংলাপ: ‘হ্যালো, কে বউমা? হ্যাঁ, শুনেছ বোধ হয় গেস্ট এসেছেন একজন। হ্যাঁ, রাতে থাকবেন, খাবেন। হ্যাঁ, দোতালার দক্ষিণের ঘরটাই ভাল হবে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, এক্ষুনি জলখাবার পাঠাবে। লুচি বেগুনভাজা একটু ক্ষীর? নাইস। হ্যাঁ, তোমার শ্বশ্রুমাতাকে একটু এ ঘরে পাঠাও দেখি।’
একগাল প্রসন্ন হাসি। সফলতার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে দাঁড়ালেন গোলগাল এক কালো মধ্যবয়সী মহিলা। অদ্ভুত কনট্রাস্ট। একজন নির্মেদ খাড়া গৌরবর্ণ ছ ফুট পুরুষের পাশে স্থূলাঙ্গিনী, দারুণ বেঁটে, মিশকালো নারী। কিন্তু অপূর্ব সুখী একখানা স্থিরচিত্র যেন। কালোসায়েব সগর্বে বললেন: ‘খুব দুরন্ত ছিলাম। কুড়ি বছর বয়েসে বাড়ি থেকে পালাই জাহাজের খালাসি হয়ে। পরে মেকানিকের কাজ শিখি। সাতঘাটের জল খেয়ে বাড়ি এসে থিতু হয়ে তবে বিয়ে করি। বিয়েতে আমার একটাই শর্ত ছিল কেবল—মেয়ে যেন কালো আর বেঁটে হয়।’
: এমন অদ্ভুত শর্ত কেন?
: আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আমাদের দেশে কালো আর বেঁটে মেয়েদের বড় হেনস্থা। তারা যাবে কোথায়? কালো আর বেঁটে বলে ভাল বিয়ে হবে না? আমার ছেলের বিয়েও দিয়েছি কালো মেয়ের সঙ্গে। তো আপনাকে যা বলছিলাম। নেভির চাকরিতে অনেক টাকা রোজগার করেছিলাম তাই আর গোলামি করিনি কোনওদিন। ছিলাম জাহাজের মেকানিক। যন্ত্রপাতির দিকে খুব শখ। এ সব টেলিফোন জেনারেটর নিজে করেছি। চাষবাস করবার জন্যে নিজে ট্রাক্টর চালাই, ছেলে চালায়। কারুর ধার ধারি নে।।
: আপনাকে কালোসায়েব বলে কেন?
: কারণ আমার সব টিপটপ। বাড়িতে এই দেখছেন ধুতি আর বেনিয়ান। কিন্তু বাইরে বেরুলেই ট্রাউজার, ফুল স্লিভ শার্ট আর বুট। ওই সব লুঙ্গি, পাজামা, হাওয়াই চটি, হাওয়াই শার্ট আমার চলে না। ও সব সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ারের পর এসেছে। আমি টেরিকটনও পরি না। সব কটন।
মজার মানুষটিকে ঘাঁটাতে বেশ লাগে। বলে বসি: গ্রাম থেকে কিছু কেনেন না?
‘কেন কিনব? জমিতে অঢেল সবজি তরকারি, পুকুরে মাছ। পোলট্রিতে ডিম। মাসে একবার পোস্তাবাজার থেকে সারা মাসের আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-তেল-মশলা-চা- চিনি কিনে লালগোলার ট্রেনে চাপাই। তারপরে মুড়োগাছা স্টেশনে নামিয়ে নিই। তারপরে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে সোজা এই রাখালগাছি। বাস।’
ইতিমধ্যে সুবাসিত চা আর জলখাবার পর্ব চুকেছে। মানুষটির দিকে তাকিয়ে বিস্ময় আর শেষ হয় না। ভদ্রলোক তাঁর মনের কথা বলার মতো লোক পান না বোধ হয়। তাই অনর্গল বলে চলেন, ‘এই গ্রাম নষ্ট হয়ে গেছে। রটন। সবসময় গমকল ভটভট করছে, ট্রানজিস্টার ক্যাঁ ক্যাঁ করছে, বাজার-হাটে কতকগুলো কুচ্ছিত মাছ বিক্রি হয়, জঘন্য সব নাম: তেলাপিয়া, সাইপিয়ন, গ্রাসকাপ। কপি, বেগুন মুলো খান কোনও টেস্ট নেই, সব বিষ ছড়ানো। বাজার করেন নিজে? শুনুন একটা টিপস দিই— বাজারে বেছে বেছে কানা বেগুন কিনবেন। ওতে কীটনাশক দেওয়া নেই। যে সব তরকারি দেখবেন চকচক করছে কক্ষনও কিনবেন না, সব ফসফেটে ভর্তি।’