: বুঝেছি। এবার গল্পের বাকিটুকু বলি। তারপর তো সারারাত সেই ঝটর পটর কিন্তু হাত আর ছাড়ে না। এদিকে তোমাদের গুরুঠাকুর ধ্যানবলে সবই জেনেছিলেন। সকাল হতে সকলকে ডেকে এনে মন্ত্রবলে চোরকে ছাড়ালেন। চোর বেটা গুরুর পা চেপে ধরে বললে: ‘তোমার মহিমে আগে বুঝিনি বাবাঠাকুর। তা হলে কি এই গুখোরি কাজ করি? আমাকে বাঁচান বাবা’। সেই থেকে এ বাগানের ফল-ফুলারিতে আর কেউ হাত দেয় না। কী ঠিক বলেছি না?
‘এক্কেবারে ঠিক’, বিস্মিত সেবাদাসী সম্রম নিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে অনেকক্ষণ নিরিখ করে বলল: তুমি বাবা কোন গুরুঠাকুর? কেমন করে জানলে?
আমি বললাম: ঠিক এই গপ্পো আমি পাঁচটা আখড়ায় শুনেছি তো? ব্যাপার কী জান? ওই চোরটা ছিল সাজানো আর তোমাদের গুরুঠাকুর আসলে হলেন বাংলার জাতীয় পক্ষী। অর্থাৎ যাকে বলে ঘুঘু।
সেখান থেকে সুড়ৎ করে কেটে পড়ে আখড়া সংলগ্ন চায়ের দোকানে বসি এবং সংগ্রহ করি গুরুঠাকুরের উদাহরণীয় জীবনী। আখড়া সংলগ্ন গ্রামেই শ্রীমৎ-এর আদি বাস্তু। জাতে সদগোপ। বাপ ছিল নাংলা চাষা। বৃত্তি পাশ দিয়ে শ্রীমান ভিড়ে যান পাটুলীর এক সহজিয়া আখড়ায়। সেই থেকে সহজানন্দে আছেন। বাপ বিয়ে দিয়ে ঘরে টেনেছিল। বউ কেন যে গলায় দড়ি দিল কেউ জানে না। ইনি ততদিনে বৈরাগ্য নিয়ে এখানে থানা গড়েছেন। ভারতবর্ষ সেকুলার দেশ। এখানে সাধন-ভজনের কোনও বাধা নেই। ধর্ম আর কর্ম। তার পরে ধর্ম থেকে ধাম অর্থাৎ এই আখড়া, আর কর্ম থেকে কাম। এমন মান্যমান রাতস্মরণীয় ব্যক্তির কাহিনী অমৃত সমান। সে সব শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সাঁঝবাতি জ্বাললেন সেবাদাসীরা। একবার খড়ম পরে উঠোনে ঘুরে গেলেন শ্রীমৎ। আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি এক পরম পাপী আর তিনি এক মহান মিনি সাঁইবাবা।
কিন্তু আমার মনে এ কথা না এসে পারল না যে এত সেবাদাসী কোথা থেকে আসে। আগে ভাবিনি তবু জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে মনে এল। এ পোড়া দেশে বৈধব্যেরও শেষ নেই, সেবাদাসীরও নেই কমতি। গ্রামদেশের গরিব গলগ্রহ নিঃসন্তান বিধবা কি কম? ভাসুর-দেওরের উটকো কামাগ্নি থেকে বাঁচতে কেমন করে এরা গুরুবরণ করে, জুটে যায় আখড়ায়, কারা তাদের টানে, ফুসলোয়, উপহার দেয় যৌনরোগ, সে সব কিছুর সামাজিক ইতিহাস কে লেখে? সঙ্গে সঙ্গে রুকুনপুরের মদনগোপালের মেলায় দেখা একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে মনে। সেবারে কিশোরদাস আর তার বউ রূপকুমারী ঘুরে ঘুরে বাউল গান গাইছিল। হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে পেট খামচে মাটিতে বসে পড়ে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগল রূপকুমারী। এমনি চটকদার রূপসী মেয়ে। ব্যথায় মুখখানা করুণ। ছুটে যেতে আমাকে বললে: বাবুগো, আর বাঁচবনি। না খেয়ে খেয়ে আমার পেটে গ্যাসটিক। যম যন্তন্না।
সেই রূপকুমারীকে আবার দেখি অগ্রদ্বীপের মেলায় কদম গাছতলায় ভিক্ষে চাইছে। কোটরাগত চোখ, মলিন চাহনি, রোগা, প্রেতের মতো চেহারা। একজন চেনা বৈরাগী কানে কানে বলল: বাবু, ঠিকই ধরেছেন। এ সেই রূপকুমারী। কী গান গাইত মনে আছে? রূপের কী চেকনাই বাহার ছিল? সব গেছে।
: কী হয়েছে ওর? কী রোগ?
ফিসফিস করে লোকটা বলল: খারাপ রোগ। কত বৈরেগী ওকে শুষে খেয়েছে জানেন? ও তো ঘরের বউ ছিল। বিধবা হতে কিশোরদাস ওকে ফুসলে বার করেছিল।
: এর কোনও প্রতিকার নেই?
: প্রতিকার আবার কী? এরা তো আপ্ত ইচ্ছায় এ পথে এসেছে। প্রথমে বোঝেনি। যখন বোঝে তখন সমাজে জায়গা কই আর। আপনাকে বলছি বাবু, এ আমি অনেক দেখলাম, বাউলবৈরেগীর যৌবন টেকে না। এদের মরণ গাঁজায় আর কামে।
আখড়া সংলগ্ন চা অলাও প্রায় একই কথা বলল, ‘এত যে দেখছেন সেবাদাসী তার মধ্যে ভক্তিমতী আর কজন? বেশির ভাগ আনখা মেয়েছেলে। কোথা থেকে জুটে যায়। সব উসকো আড়কাঠিতে নিয়ে আসে। আখড়া কে আখড়া এই বিত্তান্ত। নিজেরা সব নষ্ট হয়েছে, আবার এরাই গেরস্তের বউ ঝিদের ধম্মের নামে এখানে এনে নষ্ট করবে। এখানে বসে কত দেখলাম।’
: গ্রামের লোকেরা প্রতিবাদ করে না?
: অজ্ঞ মূর্খ সব চাষার বাস। তায় বেশির ভাগ মুসলমান। কী বলবে? ধম্ম নিয়ে কথা বললে রায়ট বেধে যাবে।
ফেরার পথে গ্রামের মুখে অন্ধকারে আমার মুখে ঝলসে উঠল তীব্র এক টর্চের আলো। ‘কে? কে যায়?’ এটাও গ্রাম দেশের রীতি। টর্চধারী যুবক আমার পরিচয় জানতে চাইল। তারপরে ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘ও, মহাপুরুষ দর্শনে গিয়েছিলেন?’
তবে যে চা অলা বলল প্রতিবাদ নেই। ভাল লাগল প্রতিবাদী যুবকের বিদ্রূপ। সে বলে চলল, ‘তা আপনাকে তো শিক্ষিত শহুরে লোক বলেই মনে হচ্ছে, এখানে কেন? দাদা কি একেবারে ফেঁসে গেছেন? তো মহাপুরুষ কত টাকা চাইল? দুশো না আড়াইশো?’
চমকে গিয়ে বলতেই হল, ‘মানে? উনি কি দীক্ষা দিতে অত টাকা নেন?’
ততক্ষণে আধোরহস্যের মায়া জাগিয়ে কোদালে-কুড়লে মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো একটু একটু দেখা দিচ্ছে। অচেনা যুবকটির মুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট। অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার কথা শুনে প্রথমে মনে হচ্ছিল ন্যাকা বোষ্টমের মতো। এখন বুঝেছি কিস্যু জানেন না মহাপুরুষ সম্পর্কে। জানেন না, ওটা একটা অ্যাবরশন সেন্টার?’
যেন মুখে একটা চাবুক পড়ল। এবারে বুঝলাম সাতগেছিয়ার পথে গুড়অলা কেন সেদিন আমার স্ত্রীকে মনে করেছিল আনখা মেয়েছেলে। ছেলেটি গড়গড় করে বলে গেল; গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরলে এমন অ্যাবরশন সেন্টার মাঝে মাঝে পাবেন। তবে বাইরে থেকে বোঝা শক্ত। ওপরে ধর্মের মোড়ক। নামগান কেত্তন হচ্ছে। মেলা মচ্ছব, দিবসী, পাব্বন সব চলছে। নাটের গুরু একজন আছেন। পতিহারার পতি ফিরে আসবে, অন্ধ পাবে দৃষ্টি, বোবায় কথা বলবে, বাঁজা মেয়ের সন্তান হবে, এ সব হচ্ছে প্রকাশ্য শ্লোগান। আসলে এ সব আখড়া সেমি-ব্রথেল। আর গ্রাম দেশে কোনও মেয়ে যদি হঠাৎ প্রেগন্যান্ট হয় তবে তাদের বাপ-মা এইসব আখড়ায় মাসখানেক রেখে যায়। গ্রামের লোকদের বলে, মেয়ে গেছে গুরুসেবা দিতে। তারপর মেয়ে দিব্যি খালাস হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। দু-একটা মরেও যায়। চরের বালি খুঁড়ে, ডেডবডি হাপিস করে দেবারও লোক আছে। থানা বহুদূরে। সেখানে নিয়ম করে গুরুঠাকুর প্রণামী পাঠান। সব ঠিকঠাক চলছে। এই তো আমাদের দেশ।