কঠিন ডাকাতি? প্রথম দিন বিশেষণটা হজম করতে পারিনি। পরে দেখলাম মুর্শিদাবাদ জেলার বাগড়ী অঞ্চলে কঠিন শব্দটা সুন্দর বা ভয়ংকর অর্থে চলে। বেলডাঙার ইসানালি সেবারকার বিধ্বংসী বন্যার বিবরণ দিতে গিয়ে বললে: ‘বাবু আমাদের সব দিগরে এবারে হয়েছিল কঠিন বন্যা।’ কুমীরদহের শিবশেখরের বাড়িতে মচ্ছবের খিচুড়ি খেতে খেতে একজন বলে উঠলে আমাকে, ‘খুব কঠিন খিচুড়ি, না কি কহেন?’
কিন্তু সে কথা থাক। আপাতত কঠিন থেকে সরে আসি। হচ্ছিল গ্রামের মানুষের সন্দেহ বাতিকের কথা। তাদের এত যে প্রশ্ন, এত অবিশ্বাস, অথচ আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেই অদ্ভুত নির্বিকার জবাব মিলবে।
সেবার যাচ্ছি সাতগেছিয়ার গ্রামের রাস্তা ধরে। দু পাশে আল-বাঁধা ভুঁই, মাঝখানে তৈরি-হয়ে-হাওয়া সরু পথ। শস্যের টাটকা ঘ্রাণ এবং গোবরের। পাঁচনি হাতে চাষা থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। মাঠের মাঝখানে অদ্ভুত এক গাছতলায় আখের রস জ্বাল হচ্ছে। প্রশ্নটা উঠল আমার স্ত্রীর মনে: ‘এটা কী গাছ?’ যে রস জ্বাল দিচ্ছিল তাকে জিজ্ঞেস করতেই আনমনে উদাসীন উত্তর এল: ‘ওই গাছটা? হ্যাঁগো তোমরা জান নাকিন কী গাছ ওটা?’ খ্যাখ্যা করে নিজেই খানিকটা হেসে বললে: ‘ওটা তাহলে কী-জানি গাছ কিংবা না-জানি গাছ।’ এর পরেই এক মর্মভেদী নগ্ন প্রশ্ন: ‘তা আপনাদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে? কোথায় যাওয়া হবে? সঙ্গে কি আপনার নিজের পরিবার না আনখা মেয়েছেলে?’
অপমানিত স্ত্রীকে নিমেষে চোখের ভ্রূকুটিতে সামলে আমি ঠিকানা পেয়ে যাই এক নির্জন আখড়ার। ঠারেঠোরে আনখা মেয়েছেলের ইঙ্গিত বুঝতে আমার দেরি হয় না। আমার মনে পড়ে যায় অন্ধ এলা ফকিরের সতর্কবাণী: ‘বাবু, তুমি এ পথে নেমেছ, খুব আপ্ত-সাবধান থাকবা। এ লাইনে হরেক মানুষ। সব বাউল-বৈরাগী উদাসীন সেজে আছে। সবাই কি তাই? শোনো তুমি, শুনে রাখো। বৈরেগী পাঁচ রকম—চ্যাটান্তি, প্যাটান্তি, মালাটেপা, ওষুধবেচা আর অ্যালাখ্যাপা। কিছু বুঝলে?’
কী করে বুঝব? শহুরে সংস্কৃতির মার্জিত মানুষ। তার ওপরে মহাবিদ্যালয়ে পুঁথিপড়া জ্ঞানদান করে পোক্ত। আমার অসহায় মুখখানা অন্ধ এলা ফকির ভাগ্যিস দেখে নি। একটু তদগত হেসে এলা বলেছিল: ‘শোনো তোমাকে বুঝিয়ে দিই। বাউল-বৈরাগীর মধ্যে বেশির ভাগ প্যাটান্তি মানে পেটের ধান্দায় ভেক নিয়েছে। ভজন নেই, ভোজনে দড়। খাওয়া ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আর মালাটেপা মানে ভেতরে ঢুঁঢুঁ, শুধু চোখ বুজে তসবি মালা টিপছে। সাবধান। ওষুধবেচা বৈরাগী কেমন জান? কতকগুলো জড়িবুটি নিদেন-পথ্য জানে, ওই বেচে খায়। সাধনভজন জানে না। আর অ্যালাখ্যাপা মানে গেঁজেল। সাধনভজনের চেয়ে ছিলিমের দিকে ঝোঁক। সব ঊর্ধ্বচোখ অধোমুখ, হাসি-হাসি ভাব। এদের যতটা পারো এড়িয়ে চলবা।’
‘আর চ্যাটান্তি?’ আমি খেয়াল রেখেছি এলা ফকির প্রথমটা প্রথমে বলেনি।
এলা রুষে উঠল, ‘অশৈল কথাটা তুমি সেই উচ্চারণ করলে? ও কথাটা খারাপ। খুব খারাপ। শোনো তোমাকে বলি, ও কথাটার মানে যারা ধম্মের নামে মেয়েমানুষ ভোগ করে কেবল। বাবা, খুব সাবধানে থাকবা।’
: এত সব চিনব কী করে। দেখলেই তো বোঝা যায় না।
: সব বুঝবে। লক্ষণে ধরা পড়বে। তিনিই চিনিয়ে দেবেন। ওই যে খারাপ কথাটা বললে, ওদের আখড়ায় দেখবে শুধুই মেয়েছেলে, আনখা মেয়েছেলে। তাদের মুখগুলো দেখবে নিপাট ভালমানুষের পারা।
সেই আনখা মেয়েছেলে কথাটা এলা ফকিরের পর দ্বিতীয়বার শুনলাম এই সাতগেছিয়ার গ্রামে। সেদিন আর নয়। পরের রবিবার আবার হাজির হলাম। এবার একা। রস জ্বাল দেবার কারিগরই এবারে হদিশ দিলে: ‘সোজা দুখান মাঠ ভাঙলে পাবেন একখানা তেঁতুল গাছ। ওইটে নিশানা। বাস, ডান দিকে পোয়াটাক হাঁটলেই নদী। নদীর পরপারে আখড়া।’
ধারাগোলের নির্দেশ মেনে একেবারে সটান পৌঁছে যাই আখড়ার চত্বরে। তকতকে উঠোনে যত না গোলা পায়রা তত ছেলেমেয়ে। নানা বয়সী। সুনসান গ্রীষ্মের দুপুর। দক্ষিণ চরের আখড়ায় গরম বাতাস মারছে ঝাপট। আমি এদিক-ওদিক খানিক ঘুরে একটা একানে দাওয়ায় উঠে জানালা দিয়ে ঘরে উঁকি মেরেছি। সর্বনাশ, এ কী দৃশ্য? দেখি এক মাঝবয়সী মানুষের দুই হাঁটুতে বসে দুই নারী। লোকটির টেরিবাগানো দিব্যি বাবরি। সাদা মেরজাই সাদা ধুতি। মুখে নিশ্চয়ই গাঁজার বিড়ি। তাতে অগ্নিসংযোগ করবার জন্যে মধুর হাতাহাতি করছে তার দুই জানুর ওপর বসে দুই সেবাদাসী। মানুষটির আনন বহুদর্শী ঝুনো। ঠোঁটে হাসি। চোখ বন্ধ। বাপরে, এ যে কালীঘাটের জ্যান্ত পট! অনিবার্যভাবে এলা ফকিরের বলা সেই অশৈল শব্দটা মনে খেলে গেল। আর মনে পড়ল: ‘সাবধান, আপ্ত-সাবধান থাকবা।’
আর কি দাওয়ায় থাকতে আছে? একছুটে একেবারে বাগানে। সেখানে আবার আরেক আশ্চর্য। ভরা জ্যৈষ্ঠের অনেক আমগাছে ফলে আছে অজস্র আম, পুরুষ্ট নধর। সবুজ পাতা আর হলুদ আমের দোলাচল। অভিনব দৃশ্য বইকী, বিশেষত হালের গ্রাম বাংলায়। কেননা এখন ফাগুন চোতে আমের গুটি পুরুষ্টু হলেই ভেন্ডাররা গাছ ভেঙে সব কাঁচা আম চালান করে দেয়। অথচ এখানে বাবাজির আখড়ার বাগানে পাকা আম তো কেউ নেয় না।
আমার ঊধ্বচরী চাহনি দেখে এগিয়ে এল এক সেবাদাসী। বলল: পাকা আম দেখে অবাক হচ্ছ? এর মূলে আমাদের গুরুদেবের মহিমে। শোনবা সেই বিত্তান্ত? বছর পাঁচেক আগে আমাদের এই আখড়ার বাগানে এক ভেন্ডার এয়েলো আম চুরি করতে। তা আমাদের গুরু-ঠাকুরের মহিমে তো জানত না বেটা। যেই আমে হাত দিয়েছে অমনি হাত গেছে এটকে। তখন তালকানা পাখির মতো সারারাত ঝটর পটর ঝটর পটর।