আমার ঘুমও নেই, নামাজও নেই। আমি নিঃসঙ্গ জিজ্ঞাসু। আমার সঙ্গী বলতে রবীন্দ্রনাথের সেই গান: ‘ফিরি আমি উদাস প্রাণে/তাকাই সবার মুখের পানে’। সত্যিই কত জনের মুখের দিকে তাকিয়েই যে আমার জীবনের অর্ধেক কাটল। এই সব আপাত অর্থে অজ্ঞ মূর্খ মানুষগুলো আমাকে যা শিখিয়েছে জানিয়েছে তার কণামাত্রও কি পেয়েছি শিষ্ট বিদ্বান মহলে? এই তো সন্ধ্যাবেলাতেই মোহন খ্যাপার মতো সাধারণ স্তরের গাহক আমাকে যে-পথরেখা দেখাল তা কি আমার বিদ্যেবুদ্ধির পুঁজি থেকে কোনওদিন বেরোত? বসে আছি ময়দানী বিবির হাতে তৈরি নকশি কাঁথায়। তাতে জড়িয়ে আছে যে-সেবাধর্মের তাপ, যে-সুন্দরের অভিবন্দনা তার কি আমি প্রতিদান দিতে পারব কোনওদিন? অনিমীল চোখে বসে আছেন বারখেদার ফকির। জীবনের কত বড় সম্পদ আর সম্পন্নতা পেয়ে গেছেন আপন অন্তরে। সে শান্তি, সে নিশ্চিতি কি একটুও আছে আমার অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতায়? এই সবই ভাবছি, আবার নবলব্ধ চৈতন্যতত্ত্বের কথাও ভাবছি। সেই যে পাটুলী স্টেশনে বাউল গোঁসাই বলেছিল, ‘তোমার একটু দেরি আছে, তবে জানতে পারবে তাঁকে’ কত দেরি আর? রাতচরা পাখির হঠাৎ ডাকে চিন্তার সূত্র কেটে যায়। রাত কি তবে শেষ হয়ে এল? যেন একটা শীতের কাঁপন শেষরাতে শরীরকে জানান দেয়। একটু একটু চোখ জ্বলে। আমি খুব নির্ভার শূন্য মনে আশ্চর্য এই মানব পরিবেশে খানিকটা বিস্ময় পোহাই। শস্যের গন্ধ ওঠে উদাসী।
চিন্তায় ডুবে ছিলাম আনমনা। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল খস্খস্ আওয়াজে। দেখি, দাওয়া থেকে খুব চুপিসারে উঠে ফকির যাচ্ছেন পুকুরে গোসল সারতে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল মোহন খ্যাপা। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমি খবর নিয়ে জেনেছি। মস্তবড় জাননেওয়ালা মুর্শিদ ওই আলাল ফকির। একশো বছরের ওপরে বয়স। শেষ রাত থেকে ঘাপটি মেরে বসে আছি। চলুন বাবু পুকুর ঘাটে যাই, ধরি ওনাকে। এই তো সময়। বারখেদার ওই লোকগুলো আমারে বলেছে, ফজরের আগে গোসল সারার ঠিক পরে ফকিরকে যা জিজ্ঞেস করা যাবে তার জবাব মিলবে। তারপর সারাদিন তো থাকবেন মৌনী। চলুন চলুন। আপনার কোনও নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে ইচ্ছে নেই?’
নিগূঢ় তত্ত্ব? হ্যাঁ, চৈতন্যতত্ত্বই তো সঠিক জানা হয়নি। সুকান্ত বলেছিলেন দরবেশরা জানেন তা। তবে কি সেই সুযোগ এল এতদিনে? স্বপ্নতাড়িতের মতো গিয়ে দাঁড়ালাম লুকিয়ে এক বকুল গাছের আওতায়। এবারে শুধু অপেক্ষা। গন্ধে বুঝছি, বুনো ফুলের আর্দ্র অস্তিত্ব। আবছা অন্ধকার। এক, দুই, তিন, চার…..মুহূর্ত এগোচ্ছে। কোন সাধক বলেছিলেন যেন, This is the hour of God’s awakening। ওই তো ওই যে আলাল ফকির সোজা উঠে আসছেন। সপসপ আওয়াজ উঠছে। আলখাল্লার শেষপ্রান্ত ভিজে গেছে না কি? তাঁর চোখ সুদূর মগ্ন উদাস, অন্য জগতে। ঠিক আততায়ীর মতো চকিতে গিয়ে সামনে দাঁড়াই আমি আর মোহন খ্যাপা। প্রথমে সামান্য ত্রস্ত, তারপরেই ক্ষমার উজ্জ্বল শান্ততায় চোখ ভরে তাকালেন, ‘বলো বাবা, কী জানবে?’ বহু বাসনায় বহুদিনের আকুলতা মিশিয়ে জানালাম অভিলাষ। হাসলেন সামান্য। তারপরে হাতটা ওপর দিকে তুলে বললেন, ‘কী জান বাবা, মাথার মণি বিন্দুই কৃষ্ণ। তাঁর যাতায়াত দেহের মেরুদাঁড়া ধরে বায়ুর ক্রিয়ায় লিঙ্গের মুখে। তাঁর রসরতির খেলা নিত্যানন্দের দ্বারে। প্রথমে কৃষ্ণ মণিকোঠা থেকে যাবেন অধোবেগে যোনিমুখে। এবার সাধক তেনারে দমের বলে উলটে নিয়ে ঊর্ধ্ব বেগে নিয়ে যাবেন মণিকোঠায় ফিরিয়ে। যখন তিনি অধোমুখী তখন তিনি ‘ধারা’। যখন উলটে গিয়ে হলেন ঊর্ধ্বমুখী তখন তিনি হলেন ‘রাধা’। এইভাবে চলবে ধারা থেকে রাধা আবার রাধা থেকে ধারা। এই চলাচল আর স্থিতির নাম গৌর। বুঝলে? ধারার বরণ শ্বেত, রাধার বরণ পীত। দেহের মধ্যে গৌরকে কায়েম করতে বহু বহু বছর লাগে বাবা। নিত্যানন্দ সহায় হলে তবে তো গৌর পাবে। গৌরচাঁদকে ধরো। শান্তি পাবে।’
চলমান পদশব্দ জানিয়ে দিল ফকিরের প্রস্থান। দাঁড়িয়ে রইলাম গাছের মতো স্তব্ধ গভীরতায়। খুব ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল এক বর্ণময় নিষ্পাপ বায়ুপূরিত স্বচ্ছ দিনের ঊষাকাল।
* কায়ব্যূহ ধরো গৌরঃ কামশাস্ত্র প্রবীণকঃ।
অসংখ্যনায়িকাঃ প্রাপ্য শৃঙ্গারৈ অতষয়ৎ ॥
* দ্ৰ শ্ৰীশ্রী গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-জীবন (২য় খণ্ড): শ্রীহরিদাস দাস। পৃষ্ঠা ৮৪
** ক্ষিতীশ-বংশাবলী-চরিত। মঞ্জুষা সংস্করণ ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ১৯
২
২. গভীর নির্জন পথের উলটো বাঁকে
সত্যিকারের মনের মানুষকে যারা খোঁজে তারা নিশ্চয়ই প্রথমে খুঁজতে চায় সেই গভীর নির্জন পথ। কিন্তু আমি যখন মনের মানুষের পথসন্ধানী মানুষগুলিকে গ্রামে গ্রামে খুঁজে বেড়াতাম তখন আমার পথ ভরা থাকত অজস্র মানুষে। তারা পদে পদে সামনে এসে দাঁড়াত। বিপুল তাদের জিজ্ঞাসা এবং সবই ব্যক্তিগত। ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’ ‘আপনি কার বাড়ি যাবেন?’ ‘আপনি যেসব কথা জানতে চাইছেন তা বলব কেন? তাতে আমাদের কী লাভ?’ ‘এ গাঁয়ে কেউ কি আপনাকে চেনে? তবে আপনারে বিশ্বাস করব কেনে?’ ‘জানেন, দু বছর আগে গরমেন্ট থেকে একটা লোক এয়েলো গাঁয়ে কটা ঢেঁকি আছে তাই গুনতে। গুনেগেঁথে তো চলে গেল, তার পরেই হল কঠিন ডাকাতি।’