শুক্র খাই।
পলকে পলকে গুরু যেন তোমায় দেখতে পাই।
গোঁসাই আলেকসাঁই তুমি থাকো সাক্ষী।
যে বয়সে খাইলাম চারিবস্তু সেই বয়সে থাকি।
দোহাই দীননাথ। ৩ বার।
বুঝলাম, এখানে যে চারিবস্তুর কথা বলা হয়েছে তা হল মল মূত্র রজ বীর্য। তার মানে এ এক দারুণ গুহ্যমন্ত্র।
ফকির বললেন: কুবিরের গানে এই কথাটাই আছে অন্যভাবে। চরণ পালের শিক্ষায় তিনি লিখেছেন:
শনি শুককুল বীজরূপে এক
আর আতস খাক বাদ চারে এক চারের মধ্যে এক।
বুঝে দেখো সৃষ্টির বিষয়।
আল্লা আত্মারূপে সব শরীরে বিরাজে সর্বময়।
এখানে ‘শনি শুককুল’ মানে বুঝলেন? শনি মানে শোণিত, স্ত্রীরজ। শুককুল মানে পুরুষের শুক্র। এইবারে আমাদের ঘরের সত্য মন্ত্র শুনুন:
ক্লিং শিং দীনদয়াল সাহেবধনী সহায়।
গুরু সত্য। চারিযুগ সত্য। চন্দ্রসূর্য সত্য।
খাকি সত্য। দীননাথ সত্য। দীনদয়াল সত্য। দীনবন্ধু সত্য।
আরেক মন্ত্র শুনুন—
ক্লিং সাহেবধনী আল্লাধনী দীনদয়াল নাম সত্য।
চারিযুগ সত্য। কাম সত্য। করণ সত্য। ঠাকুর সত্য।
দীনদয়াল সত্য। দীননাথ সত্য। দীনবন্ধু সত্য।
গোঁসাই দরদী সাঁই/তোমা বই আর আমার কেহ নাই।
আরেক গুহ্য মন্ত্র নিগূঢ়:
গুরু তুমি সত্যধন। সত্য তুমি নিরঞ্জন।
খাকি তোমার নাম সত্য। কাম সত্য। সেবা সত্য।
ঠাকুর সত্য। বাক সত্য। গুরু সত্য।
ফকির থামলেন, কিন্তু আমার মনে শুরু হল ধন্দ। এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? এ সবের মানে কী? অনেক শব্দ যে জীবনেই শুনিনি। এ সব নিয়ে আমি কী করব? যেন মুক্তি পাবার জন্যে বললাম, আমি এর কোনও মানে বুঝছি না। করণ মানে কী? খাকি মানে কী? আল্লা বলছেন আবার ঠাকুর বলছেন। দীনদয়াল কে? দীনদয়াল কী?
প্রসন্ন মুখে হাসলেন শরৎ, ‘একদিনে সব বুঝে ফেলবেন? এ সব অনেক দিনের করণ। এখন খাতা থেকে টুকে নিন সব। এখানে থাকুন আজ, এই ঘরে। কেউ জানবে না। সব টুকে নিন। তারপরে দেব কবজ তাবিজের খাতা। রোগ সারাবার ভেষজ বিবরণ।’
: কুবিরের গানের খাতা দেবেন না?
: সকলেরই দেখি এক চাহিদা। কুবিরের গানে কী আছে বলুন তো? আগে তো চরণ, তবে তো কুবির। তার গানে তো আমাদেরই মন্ত্র আর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা। এমনি এমনি সে সব বুঝতে পারবেন! যদি বোঝেন তবে সে হবে বাইরের মানে।
: তাই নাকি?
: হ্যাঁ। অবশ্যই। আচ্ছা কুবিরের গানটাই শুনুন। গাইতে তো পারি না, মুখে মুখেই বলি—
আগে ছিল জলময় পানির উপর খাকি রয়
খাকির উপর ঘরবাড়ি সকলরে।
ভাই রে যে আল্লা সেই কালা সেই ব্ৰহ্মবিষ্টু
ও সেই বিষ্টুর পদে হল গঙ্গার সৃষ্টিরে।
এবারে একটু মানে বুঝে নিন। খাকি মানে মাটি, ফারসি শব্দ। বিষ্ণুর পাদপদ্মই মাটি। সেইখান থেকে গঙ্গার সৃষ্টি। গঙ্গা মানে পানি। পানি মানেও মাটি। মাটি মানেও পানি। আব আর খাক। হিন্দু মলে গঙ্গা। মুসলমান মরলে মাটি। দুইই এক। কিন্তু যখন প্রলয় হবে?
ভাইরে হিন্দু মলে গঙ্গা পায় যবন থাকে জমিনায়
শাস্ত্রমতে বলি শোনো স্পষ্টরে।
যখন এই খাকি একাকী সরে দাঁড়াবে
তখন সব নৈরাকার হবে।
সংসার যাবে রে গঙ্গা গঙ্গাজলে মিশাবে।
বুঝে দেখো দেখি হবে কি খাকি পালাবে
যবন মলে কব্বর কোথা পাবে রে।
এই সংসার অসার হবে ঘরবাড়ি কোথা রবে
এই কথাটির বিচার করো সবে রে।
পানি আছেন কুদরতে খাকি আছেন পানিতে
খাকির ওপর স্বর্গমর্ত্য পাতালের এই কথা
আব আতস খাক বাদ চারে কুলে আলম্ পয়দা করে
হিন্দু যবন জানে না কিছু বোঝে না বিরাজে এই সংসারে ॥
কুদরতি মানে দৈবীশক্তি। কুলে আলম্ মানে ঈশ্বর। তা হলে কথাটা কী দাঁড়াল। হিন্দুর গঙ্গা, মুসলমানের মাটি, এ সব কিছুই থাকবে না। থাকবেন কুলে আলম্ আর তাঁর কুদরতি। থাকবে আব আতস খাক বাদ। হিন্দু মুসলমান তোমরা সব ভেদবুদ্ধি ত্যাগ করে দীনদয়ালকে ডাকো।
কথাটা স্পষ্ট হল। তারই টানে আমি বললাম: আপনাদের ধর্মবিশ্বাসে রয়েছে সমন্বয়ের কথা। আল্লাধনী রাইধনী এই দুইয়ে মিলিয়ে আপনাদের সাহেবধনী। বড় আশ্চর্য। এর কারণ আমার মনে হয় প্রথম যে উদাসীনের কাছে আপনাদের দীক্ষাশিক্ষা হয়েছিল তিনি ছিলেন কাদেরিয়া সুফি সম্প্রদায়ের।
ফকির বললে: তা হতে পারে। দীনদয়ালের ঘরে গেলে আমরা ঘোমটা দিই জানেন তো?
: ঘোমটা দেন? তা হলে আর সন্দেহ রইল না।
শরৎ ফকিরের সঙ্গে আমার ভাবের লেনদেন এইভাবেই শুরু। মাঝে মাঝেই বৃত্তিহুদায় যাই। রাতে থাকি। মাঝরাতে কথাবার্তা হয়। একবার অগ্রদ্বীপের মেলায় আমগাছ তলায় পাশাপাশি দুটো শতরঞ্জি পেতে দুজনে শুয়ে নানা কথা বলি। ওঁর পরনে সাদা থানধুতি আর সাদা সুতি চাদর। বুকে সবসময় কালো রঙের ফকিরি দণ্ড ধরে আছেন। ওইটি কাছছাড়া করতে নেই। ওতে নাকি আছে ঐশী শক্তি।
কখন গাঢ় ঘুমিয়ে পড়েছি চৈতী হাওয়ায়। রাত তিনপ্রহরে হঠাৎ গায়ে হাত দিয়ে ডাকেন শরৎ—‘উঠুন, উঠুন, আমার ক্রিয়াকলাপ দেখবেন তো?’
সমস্ত মেলা ঘুমোচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ সমস্ত দিনের চিঁড়ে-মহোৎসবের পর ক্লান্ত নিদ্রাতুর। আকাশে একাদশীর ক্ষীণ চাঁদ। আবছা অন্ধকারে দেখলাম গোপালের মা আর তিনজন বিধবা, ফকিরের চারপাশে চারটে ধুতি দিয়ে আবরণ তৈরি করেছে। তার মধ্যে চুপিসাড়ে বসে ফকির ভাত খাচ্ছেন। আমার হতভম্ব ভাব দেখে গোপালের মা বললে ফিসফিস করে, ‘দুপহর রাতে আমরা ফকিরের অন্ন পাক করেছি। উনি তিন পহরে তা সেবা কচ্চেন। এ খাওয়া কাউকে দেখতে নেই। কাল চোপর দিন আর উনি অন্ন কি কোনও খাদ্য ছোঁবেন না। সংযমে থাকবেন। কথাবাত্তাও নয়। সারাদিন আসনে বসে থাকবেন। আবার কাল রাত তিন পহরে অন্ন সেবা হবে। অগ্রদ্বীপে ওঁর এই নিয়ম। জয় দীনদয়াল। চারযুগ এই চলছে।’