এও কম আশ্চর্য নয়। কোনও ফকিরের বাড়িতে কখনও আমি প্রণাম পাইনি। আসলে প্রণাম ওরা করে না। আর প্রণাম না বলে ‘ভক্তি দেওয়া’ এ জিনিস আমি ফরিদপুরের থেকে আসা নমঃশূদ্র সমাজ ছাড়া কখনও শুনিনি। অবাক হয়ে তাকাতেই খেজমৎ বলে, ‘কী অবাক হলেন তো? আমাদের গোঁসাই যে ফরিদপুরের এড়াকান্দির সিডিউলড্ কাস্ট ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই এ সব শেখা। আমি জন্মে ফকির, কর্মে নই। লিয়াকত ফকিরের ছেলে বলে লোকে আমাকে খেজমৎ ফকির বলে। অবশ্য ফকিরিতন্ত্রে অনেকটা রাস্তা আমি হেঁটেছি। তারপরে বছর দশেক আগে হঠাৎ বেতাই-জিৎপুরে মতুয়াদের মেলায় আমার সদগুরু লাভ হল। গোঁসাইয়ের আখড়া কুলগাছি। সেখানেই আমার দীক্ষাশিক্ষা। সহজিয়া মত আমাদের। নিত্যানন্দের ধারা।’
ধীরে ধীরে বিকেল শেষ হয়। একটু একটু হিমেল হাওয়া। গাঁয়ের লোক দুটো-চারটে করে জমছে। খেজমৎ খুব ব্যস্ত, আহ্বান আপ্যায়নে। বাউল বৈরাগীরা এসে গেছে। দুটো একটা গান হচ্ছে। শিক্ষানবিশদের গান। বুঝলাম ট্রেনিং চলছে। বাংলাদেশের দল এই এসে পড়বে আর কী। আমি এদিক ওদিক খানিক ঘুরিফিরি। উঠোনের একদিকে বিশাল কড়ায় খিচুড়ি পাক হচ্ছে। খেজমৎ সেখানে আমাকে দেখে বলে, ‘বাবুর খুব একা একা লাগছে তো? গান তো হবে সেই রাতে। তো আসুন এদিক পানে। নসরৎপুর থেকে একজন গাহক এসেছে। যাদুবিন্দুর গান জানে। গলা খুব আহামরি নয়, তবে ভাব আছে। তত্ত্ব জানে। তার গান শুনুন।’
নসরৎপুরের গাহকের নাম মোহন খ্যাপা। বিনয় সহকারে বসালে। খেজমৎ বললে, ‘বাবু, আমি যাই, ওদিকে বোধহয় বাংলাদেশের দলের খবর এল।’ আমি মোহন খ্যাপাকে বললাম, ‘যাদুবিন্দুর গৌরাঙ্গতত্ত্বের গান শোনাবে? তত্ত্ব বোঝাতে হবে কিন্তু।’
‘তত্ত্ব আর কতটুকু জানি বলুন? যিনি বোঝাবার তিনিই আমার বাক্য হয়ে আপনারে বোঝাবেন বইকী। তবে আগে যাদুবিন্দুর গুরু কুবির গোঁসাইয়ের পদ গাই একটা, শুনুন।’ দোতারা বেঁধে গান ধরে:
দয়াল গুরু হে তোমা বই কেউ নাই
আমি খেতে শুতে আসতে যেতে
তোমারই গুণ গাই।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি যিশু তুমি কৃষ্ণ,
অন্তিম কালে যেন তোমার স্বরূপ বুঝে যাই॥
চমকে গিয়ে গান থামাই। কী বললে মোহন খ্যাপা? আশ্চর্য, কোথায় যে কী মিলে যায় কে জানে? তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি কৃষ্ণ ঠিকই তো আছে? কিন্তু তুমি যিশুটা কী ব্যাপার? এ কি ধর্ম সমন্বয়ের কথা? আমার বিশ্লেষণ শুনে মোহন বলে, ‘না বাবু, আমার গোঁসাই এ গানের অন্য তত্ত্ব দিয়েছেন।’
: কী রকম?
: উনি বলেন আর সেটাই ঠিক যে বিন্দু বা শুক্র ছাড়া কেউ তাঁকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা কৃষ্ণ যে নামেই ডাকি আসলে তিনি তো এক! সেই জন্য আরেকটা পদে বলছে, ‘গৌর গৌর বলছো যারে/ সে গৌর তোমার সঙ্গে ফেরে।’ এ কথার কি ওই অর্থই নয়?
কার্তিকের কুয়াশা কেটে পূর্ণিমার চাঁদ জাগছে। আমার চেতনালোক উদ্ভাসিত করে যেন নতুন একটা চাঁদ উঠছে। কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। আমি মনে মনে বিড়বিড় করি শাস্ত্রে-পড়া শ্লোক: একশ্চৈতন্যচন্দ্রঃ পরম করুণয়া সর্বমাবিশ্চকার। এ শ্লোক কতবার ক্লাসে নিষ্প্রাণ আউড়েছি ছাত্রদের সামনে। আজকে সেই আবিষ্কার কি তবে পূর্ণ হতে চলেছে? ইতিমধ্যে আমাদের ঘিরে অনেক জমেছে। বাংলাদেশের দলও এসে গেছে। মোহন গাইছে যাদুবিন্দুর পদ:
যাদের আছে সুসঙ্গ
দেখে গঙ্গা গৌরাঙ্গ
সময় সময় সুরধুনীর বাড়ে তরঙ্গ।
গান চলে। আমি কেবল কার্তিকের কুয়াশা ভেঙে এগিয়ে যাই খেজমতের ভিটে ছেড়ে বাইরে, মাঠে যেখানে রাশি রাশি ধানের পাঁজা। গানটার মানে নিজে নিজেই খুঁজে পাই। স্পষ্টই বুঝি এ গানে ‘গঙ্গা গৌরাঙ্গ’ একসঙ্গে বলতে বোঝাচ্ছে ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নর পথে বিন্দুর চলাচল। মাঝে মাঝে সেই তরঙ্গ বাড়া বলতে বোঝায় উদ্দীপন। নিজের দেহকে জানা, নিজের মধ্যে গতিময় কৃষ্ণকে জানা যায়, তার গতায়াতকে নিয়ন্ত্রণ করে সম্ভোগ করা এই তা হলে গৌরতত্ত্ব? এ তো শাস্ত্রেও থাকতে পারে না, কাব্যেও না। এ তো লিখে বোঝানো যাবে না। সেই জন্যই কি এই তত্ত্ব গুরুশিষ্য পরম্পরায় লোকায়তিক। মৌখিক অথচ সর্বত্র উচ্চাৰ্য নয়! ক্রিয়াত্মক অথচ গোপন।
অথচ তখনও কতটা বোঝা বাকি ছিল বুঝিনি। একটা ঘোরের মধ্যেই যেন রাতটা কেটে গেল। অন্নসেবা, গানের পর গান, চাঁদনি রাত সব কোথা দিয়ে কেটে গেল আমি বুঝিনি। বসেছিলাম শেষরাতে ময়দানী বিবির কাঁথা পেতে ঘরের দাওয়ায়। গান থেমে গেছে। সব দিক চুপচাপ। কে কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে চেঁকির পাড় দেবার শব্দ ঢুপ ঢুপ ঢুপ। শেষরাতে বউ-ঝিরা উঠে ধান ভানছে। বাংলাদেশের দলটা আশ্রয় নিয়েছে আমার কিছু দূরে দাওয়ায়। সবাই পথক্লান্ত নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল একজন বৃদ্ধ ফকির বসে বসে তসবি মালা জপছে বিড়বিড় করে। খানদানি দরবেশ। জেল্লাদার আলখাল্লা। কুষ্টিয়ার বারখেদা অঞ্চলের ফকির।
বারখেদার ফকিরকে দেখে একটা কথাই মনে হতে লাগল যে মানুষটা খিদে তেষ্টা শ্রান্তি সবকিছুকেই জয় করেছেন। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়া যশোর রাজশাহী এ সব জায়গায় শুনেছি অনেক ক্ষমতাশালী ফকির আছে। ক্ষমতাশালী বলতে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা শ্বাসের কাজ আর শরীরী দুঃখকষ্টকে জয় করা। কুষ্টিয়া থেকে তিনদিন আগে রওনা হয়ে বেশির ভাগ হাঁটাপথে এই দল এসে পৌঁছেছে বাদলাঙ্গী। কিছু না হোক ষাট-সত্তর মাইল হাঁটতে হয়েছে। অথচ এখানে আসা ইস্তক এই মানুষটা খাড়া বসে আছেন। মাঝরাত পর্যন্ত সারাক্ষণ বসে ছিলেন শব্দগানের আসরে। এখন দলের সবাই ঘুমে কাদা অথচ ফকির একলা বসে আপন মনের গভীরে জপ করছেন। এরা নাকি শ্বাসের মধ্যেই জপক্রিয়া করে, শ্বাসেই এদের নামাজ। সে নামাজ অবশ্য বাতুন বা অপ্রকাশ্য। রাতের এয়সা নামাজ থেকে শুরু হয়েছে শ্বাসের ক্রিয়া, শেষ হবে খুব ভোরে, সেই ফজর নামাজের সময়।