লক্ষ করতে হবে, যে-তেরোটি উপসম্প্রদায় সম্পর্কে এখানে বিরুদ্ধতার কথা বলা হয় তার মধ্যে আউল বাউল নেড়া সাঁই আর দরবেশিরা আদৌ বৈষ্ণব নয়। কিন্তু তোতারাম যে জাত-গোঁসাই আর গৌরনাগরীদেরও অপাঙ্ক্তেয় করেছেন এখানেই বৈষ্ণব বিচ্ছিন্নতাবাদের খুব বড় প্রমাণ রয়ে গেছে। এই অসহিষ্ণুতা ও বিচ্ছিন্নতায় বৈষ্ণবরা আরও টুকরো হতে থাকে। এর পরের আরেক পয়ারে তার প্রমাণ। বলা হচ্ছে:
পূর্বকালে তেরো ছিল অপসম্প্রদায়।
তিন তেরো বাড়লো এবে ধর্ম রাখা দায়॥
এইভাবে বাহান্নটা উপসম্প্রদায় তো তখনই জন্মে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন ধর্ম রাখা দায় বলা হচ্ছে এখানে?
আমি বললাম, ‘কেন? নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব ধর্মের কথা বলা হচ্ছে। অবশ্য হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই তুলেছেন আপনি। মহাপ্রভু যে উদার জাতিবর্ণহীন বৈষ্ণবতার স্বপ্ন দেখেন, নিত্যানন্দ যাকে রূপ দিতে চান, সে কি শেষপর্যন্ত আচণ্ডাল জনসমাজের কল্যাণকামী ছিল আর কোনওভাবেই? তা কি রুদ্ধ হয়ে যায় নি সংস্কৃত শাস্ত্রবাণী আর গুরু মহান্তের ব্যাখ্যায়? সেখানে সেই উচ্চ বৈষ্ণবদের গজদন্ত মিনারে সাধারণ মুমুক্ষু নিচু জাতের মানুষ আর কী করে আশ্রয় নেবে? সহজিয়া বৈষ্ণব, জাত বৈষ্ণব আর নানা খণ্ডিত বৈষ্ণবই তো সংখ্যায় বাড়বে। ওদিকে সামাজিক স্মার্ত মত মেনে চলে যারা তারাই বৈষ্ণব ধর্মের আধ্যাত্মিক বিধি নিয়ে ক্রমে হয়ে উঠেছে এখনকার উন্নত বৈষ্ণব। তোতারাম যে স্মার্তদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করেছেন এখন তো তারাই সবচেয়ে মান্য বৈষ্ণব। দেখুন ইতিহাসের কী অদ্ভুত কৌতুক। ঠিক এখন মানে এই সময়ে বৈষ্ণব কারা? এক নম্বর, মঠ ও আখড়াধারী ব্রহ্মচারী গোঁসাই। দু নম্বর, এদের দ্বারা উপেক্ষিত জাত-গোঁসাই এবং ঘৃণিত সহজিয়া বৈষ্ণব। তিন নম্বর, গৃহী বৈষ্ণব ভদ্রলোক, যাঁদের মন্ত্রদীক্ষা হয়, হরিনাম করেন যারা অথচ মেনে চলেন হিন্দুসমাজের প্রচলিত স্মাৰ্তমত। জন্ম মৃত্যু বিবাহে এঁদের ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে। এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কী সুকান্তবাবু, ঠিক বললাম?’
‘একেবারে ঠিক’ সুকান্তবাবু সায় দেন এবং বলেন, ‘চৈতন্য মহাপ্রভুকে সঠিক কেউ বুঝল না তা হলে। কিন্তু দেহবাদী সহজিয়ারা তাদের সাধনায় যে সব কড়চা ও শাস্ত্রের দোহাই পাড়ে সেও খুব অদ্ভুত। তারা লিখেছে সে সব শাস্ত্র কড়চা নিজেরাই অথচ চালায় রূপ কবিরাজ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বীরভদ্র, নিত্যানন্দ এমনকী নরোত্তমের নামে। এমনও বলে কবিরাজ ছিলেন বীরভূমের লোক শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য। পরকীয়াবাদের সমর্থন করেছিলেন বলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব অংশ থেকে বিতাড়িত হন। প্রতিবাদী বিতাড়িত মানুষটাই নাকি তাদের আদিগুরু। এই বলে গান গায় যে,
শ্রীরূপের পদে যার নিষ্ঠা হলো
মানুষের করণ সেই সেধে গেল।
শ্রীরূপের চরণ সাধি
শ্রীরূপের পেল সিদ্ধি শাস্ত্রদেবতা দুষে গেল॥’
আমি বললাম, ‘এখানে তো শ্রীরূপের দুটো মানে রয়েছে। শ্রীরূপ মানে রূপ কবিরাজ, শ্রীরূপ মানে নারী। ঠিক তো? কিন্তু লৌকিক স্তরে যে গৌরঙ্গতত্ত্ব খুব গোপনে চালু আছে আপনি তা জানেন? আমি যতদূর বুঝেছি, পুরুষ দেহ রাধা আর তার মধ্যে মণিবিন্দু কৃষ্ণ। একাঙ্গে এটাই গৌরাঙ্গ। সেই গৌরাঙ্গের উপলব্ধি করতে লাগে নিত্যানন্দের দ্বার।’
সুকান্ত বললেন, ‘এ যে ফরমুলার মতো বলে গেলেন। না না অত সহজ নয়। মাঝখানে আপনার জানার একটু ফাঁক আছে। কৃষ্ণ রাধার আরেকটু জটিলতা আছে। সেটা আমিও জানি না। আচরণঘটিত সেটুকু। শুনেছি একমাত্র দরবেশি মতের কেউ কেউ সেটা জানে। আমি ঠিক ঠিক দরবেশি মতের লোক পাইনি। আপনি খোঁজে থাকুন।’
আমি ভাবলাম, আবার কোথায় খুঁজব? গৌরাঙ্গের মর্ম তবে কি আমার অজানাই থেকে যাবে?
শেওড়াতলার আহাদের মাজারে অম্বুবাচীতে মচ্ছব হয় প্রতি বছর। সেবার সেখানে খুব আলাপ হল বাদলাঙ্গীর খেজমৎ ফকিরের সঙ্গে। ফকির বললেন, ‘আপনি তো চাপড়া থানার কাঁহা কাঁহা সব গৈ-গেরামে ঘুরেছেন কিন্তু কখনও আমাদের বাদলাঙ্গী গাঁয়ে আপনাকে দেখিনি। একবার আসুন এবারে, হ্যাঁ, কার্তিক মাসের পুন্নিমে, ওই দিন আমার গোঁসাইয়ের পারুণী। খুব বড় মচ্ছব হবে। বসবে শব্দ গানের আসর। বাংলাদেশ থেকে বর্ডার পেরিয়ে অনেক আলেম দরবেশ ফকির আসবে। গান শুনবেন তাদের। খুব ভাল তত্ত্বের গান। আসবেন তো?’
এ সব ক্ষেত্রে ওই যেমন সায় দিতে হয় সেই রকম ঘাড় নেড়েছিলাম। পরে যথারীতি ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের শহুরে ক্যালেন্ডারে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা আর কোথায়? কিন্তু খেজমৎ ভোলেনি। লাল কালিতে লিখে এক পোস্টকার্ড ঠিকই পাঠিয়েছে মচ্ছবের সাত দিন আগে। আরও আশ্চর্য, ‘সুধীর চক্রবর্তী, প্রোপেসর কৃষ্ণনগর’ এমন অসম্পূর্ণ ঠিকানা সত্ত্বেও সে চিঠি ডাক বিভাগ আমাকে পোঁছেও দেয়। এর পর কি না গিয়ে চলে?
বাসে যেতে যেতে অবশ্য ভাবছিলাম একটা গোলমেলে কথা। খেজমৎ ফকির যার নাম, তার গুরু কী করে হন পরমানন্দ গোঁসাই? গুরুর প্রয়াণ দিবসের স্মরণেই তো এই মচ্ছব। পোঁছেই প্রথমে সেই কথা পাড়লাম। বসতে দিয়েছে খাতির করে এক অসামান্য কারুকার্য খচিত কাঁথায়। কাঁথায় সুতোর ফোঁড়ে হাতি ঘোড়া পদ্ম শঙ্খ বোনা আর এক কোণে লেখা ময়দানী বিবি বাদলাঙ্গী’। তারিফ করতেই লাজুক মুখে খোদ ময়দানীবিবি হাতপাখা নিয়ে এসে সামনে বসে৷ খিজমৎ বলে, ‘বাবুকে ভক্তি দাও।’ ময়দানী গড় হয়ে প্রণাম করে।