প্রথমে ‘আমি কী জানি বলুন’, ‘কতটুকুই বা পড়াশুনা করেছি’ এইসব গৌরচন্দ্রিকা করে সুকান্ত বললেন, ‘আসলে সহজিয়াদের সূচনা মহাপ্রভুরও আগে। চণ্ডীদাসের পদে পাবেন অনেক ইঙ্গিত। গৌড়বঙ্গে কৃষ্ণ ধামালীর একটা লৌকিক গল্প চালু ছিল, কৃষ্ণ রাধা আয়ান ঘোষ আর বড়াই বুড়িকে নিয়ে। অবৈধ প্রেমের দেহকেন্দ্রিক গল্প। জানেন তো ভাগবতে রাধার নাম কোথাও নেই? জয়দেব লৌকিক কাঠামো থেকেই রাধাকে তৈরি করেন। বড়ু চণ্ডীদাস সেই কৃষ্ণরাধার গল্পে কামনা আকুলতা ছলনা আর বিরহ বুনে তাকে জনপ্রিয় করে দেন। সহজিয়ারা এই গল্প ও গান খুব পছন্দ করত। এরপরে বৌদ্ধ সহজিয়া, তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কিছু এসে যায়। এ সব ছিল খুব গোপন।’
: কিন্তু সহজিয়ারা কি তখন ধর্মসম্প্রদায় ছিল এখনকার মতো?’
: মনে হয় না। ওটা ছিল গোপন আচরণ, সমাজের খুব অন্ত্যজবর্গে। কিন্তু মহাপ্রভুর পরে যারা সহজিয়া বলে ফুটে বেরোল তারা কিন্তু বেশ সংগঠিত ও সচেতন। আসলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের গোঁড়ামি, বৃন্দাবনের সংস্কৃতি অনেক শূদ্রের পক্ষে সহ্য হয়নি। তারা প্রতিবাদ খুঁজছিল। শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারের ‘গৌরনাগর সাধনা’, নবদ্বীপের ‘মঞ্জরী সাধনা’ আর পরকীয়াবাদের অন্য ব্যাখ্যা থেকে সহজিয়া বৈষ্ণবরা জেগে ওঠে। শ্রীচৈতন্যের গুহ্যসাধনাকে সামনে রেখে দেহ-কড়চা নামে অজস্র পুঁথি লেখা হয়। সে সবই কি শূদ্রের লেখা বলতে চান? উচ্চবর্ণের লোকেরাও ভেতরে ভেতরে সহজিয়াদের মদত দেয়নি কি আর? তবে পরে ওই নবদ্বীপ শান্তিপুর খড়দহ শ্রীখণ্ড এইসব জায়গাতেই কেবল খাঁটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা ঘাঁটি গাড়ে, সহুজেরা ছড়িয়ে যায় গ্রামে গ্রামে আখড়ায় আখড়ায়। বিকৃতিও আসে তাদের মধ্যে। তারপরে গড়ে ওঠে নানা বৈষ্ণব উপসম্প্রদায়।
: কিন্তু ঠিক কোন সময়ে এই সব উপসম্প্রদায় মাথা চাড়া দেয় বলুন তো?
: একেবারে আঠারো শতকের শেষার্ধে। সেটা বোঝাতে গেলে আপনাকে সিদ্ধ বৈষ্ণব তোতারাম বাবাজির ঘটনা বলতে হয়। শুনবেন?
: ‘অবশ্যই শুনব। এ সব বলবার মতো যোগ্য লোক তো আপনিই’ আমি বললাম।
বিনত মুখে সুকান্ত শুনলেন আত্মপ্রশংসা। তারপর খানিক ভেবে নিয়ে বললেন, ‘শ্রীনিবাস আচার্যের বংশের সন্তান রাধামোহন ঠাকুর ছিলেন আঠারো শতকের মানুষ। ১৭৮১ সালে তাঁর দেহান্ত ঘটে। বলতে পারেন রাধামোহনই বাংলার শেষ বৈষ্ণব ইনটেলেকচুয়াল। একবার বৃন্দাবনে দুজন বৈষ্ণবের মধ্যে স্বকীয়া আর পরকীয়াবাদ নিয়ে বিতর্ক হয়। কোন পথ সঠিক? জয়পুরের রাজসভার বিচারে স্বকীয়া মত জেতে। তাতে প্রতিপক্ষ খুশি না হয়ে গৌড়ের পণ্ডিতদের মতামত দাবি করেন। জয়পুরের রাজা তখন তাঁর সভাসদ ও স্বকীয়াপন্থী কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যকে বাংলায় পাঠান। নবাব মুর্শিদকুলী জাফর খাঁর দরবারে বিচার বিতর্ক হয়। রাধামোহনের কাছে তর্কে হেরে কৃষ্ণদেব অজয়-পত্র লিখে দেন। ব্যাস, সেই থেকে বাংলায় পরকীয়া মত চেপে বসল। এখানে একটি কথা বলি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে পরকীয়াবাদ এক শুদ্ধ নিষ্কাম conception। সহজিয়ারা কিন্তু সে conception নেয়নি। তারা পরকীয়া বলতে বুঝল ও বোঝাল, অবিবাহিতা সাধনসঙ্গিনী। ক্রমে কিশোরীভজন এবং পরস্ত্রীগমন হল পরকীয়া সাধনার পক্ষে প্রশস্ত।’
আমি বললাম, ‘এই পরকীয়াবাদের সমর্থনে তারা পয়ার বানাল না?’
সুকান্ত বললেন, ‘অবশ্যই। জানেন না গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা কথায় কথায় যেমন বৃন্দাবনি সংস্কৃত শ্লোক আওড়ায়, সহুজেরা তেমনই পয়ার ওগড়ায়। পরকীয়ার পক্ষে পয়ার শুনবেন?
স্বকীয়াতে বেগ নাই সদাই মিলন।
পরকীয়া দুঃখসুখ করিল ঘটন॥
এবারে যুক্তিটা শুনুন। গৌরাঙ্গকে বুঝতে পরকীয়া সঙ্গিনী কেন? স্বকীয়ার ত্রুটি কোথায়? জবাব হল, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের সত্যভামা-রুক্মিণী-কুব্জা এইসব স্বকীয়া থাকতেও তিনি কেন রাধা প্রেমকে আশ্রয় করলেন? বিশ্লেষণে বলা হল, স্বকীয়া প্রেমধর্মে বাধাবন্ধ নেই, সমাজের অনুশাসন নেই, তাই ওতে বেগ নেই। পরকীয়ায় আছে দুঃখকষ্ট ভোগের রোমাঞ্চ। উৎকণ্ঠা থেকে মিলনে পৌঁছানোর জন্য দারুণ আত্মপীড়ন, কুলত্যাগের সাহস, সমাজের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করার শক্তি। প্রেমের সত্যিকারের গভীরতা তো এ সবেই ফুটে ওঠে।’
: কিন্তু তোতারাম বাবাজির কথা কেন তুললেন?
: ওই পরকীয়াবাদ থেকেই তো সব বৈষ্ণব গৌণ সম্প্রদায়ের উদ্ভব। তারা দেখল কৃষ্ণরাধা তত্ত্বের সঙ্গে তাদের পুরুষ প্রকৃতিবাদ বেশ খাপ খায়। কৃষ্ণ হলেন তাদের সাধনার ‘বিষয়’ আর রাধা হলেন ‘আশ্রয়’। চলল নির্বিচার ‘আরোপ’ সাধনা। তোতারাম বাবাজি এদের সম্পর্কে তাঁর অসহিষ্ণুতা জানান। তার থেকেই প্রথম তেরোটি উপসম্প্রদায়ের বিষয়ে খবর মেলে। দ্রাবিড় দেশের পণ্ডিত তোতারাম ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের মানুষ। ন্যায় পড়তে আসেন নবদ্বীপ। সেখান থেকে যান বৃন্দাবন। আবার নবদ্বীপে এসে আখড়াধারী বাবাজি হন। কিন্তু সহুজে বৈষ্ণব আর অন্য গৌণধর্মীদের আচরণে ব্যথিত হয়ে ঘোষণা করেন:
আউল বাউল কর্তাভজা নেতা দরবেশ সাঁই।
সহজিয়া সখীভাবুকী স্মার্ট জাত গোঁসাই॥
অতিবড়ী চুড়াধারী গৌরাঙ্গনাগরী।
তোতা কহে—এই তেরোর সঙ্গ নাহি করি॥