এখানে অবশ্য বলে নেওয়া উচিত যে চৈতন্যকে এই গৌড়বাংলাতেই অবতার বলে, পরমতত্ত্ব বলে প্রতিষ্ঠা করাও খুব সহজ হয়নি। কেননা বৃন্দাবনের বৈষ্ণবরা কখনই কৃষ্ণতত্ত্বের বাইরে স্বতন্ত্র চৈতন্যতত্ত্বকে মানেননি। তাঁরা মনে করতেন চৈতন্য ‘উপায়’ এবং কৃষ্ণ ‘উপেয়’। অন্য দিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবকুল চাইছিলেন গৌর পারম্যবাদকে প্রতিষ্ঠা দিতে। এদিকে বাংলাতেই একদল বৈষ্ণব গৌর-নিতাই বিগ্রহ গড়ে মন্দিরে বসালেন, আরেকদল বসালেন গৌরগদাধর মূর্তি, খেতুরি মহোৎসবের পর নরোত্তম চালু করলেন গৌরবিষ্ণুপ্রিয়া যুগল মূর্তি—এটা চাননি বৃন্দাবনের গোঁসাইরা। নিত্যানন্দপত্নী জাহ্নবাদেবীর পালিত পুত্র রামচন্দ্র গোঁসাই বাঘনাপাড়ায় যে শ্রীপাট গড়েন সেখানে সহজিয়া বৈষ্ণব ভাবনার বেশ কিছু স্ফূরণ ঘটে এ কথা সত্য। চৈতন্যকে পরমতত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠায় দেশের রাজশক্তির পক্ষ থেকেও বাধা আসে। আঠারো শতকে ব্রাহ্মণ সমাজপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ভয়ে নবদ্বীপে ‘শ্রীগৌর মূর্তিকে ছয় মাস যাবৎ মৃত্তিকাভ্যন্তরে লুক্কায়িত রাখা হয়েছিল।’* নদীয়া রাজবংশের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ১৮৭৫ সালে স্পষ্ট ভাষায় লিখে গেছেন:
ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অধিকার প্রায়ই শাক্ত ও অত্যল্পাংশ বৈষ্ণব, এবং শূদ্রবর্ণের অধিকাংশ বৈষ্ণব ও কিয়দংশ শাক্ত ছিল। রাজারা শাক্ত কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ করিতেন।**
উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ের এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে শূদ্রবর্ণের অধিকাংশ বৈষ্ণব ছিল। অর্থাৎ সহজিয়া বৈষ্ণব ও জাত-বৈষ্ণব। ব্রাহ্মণ অংশের মূল ভাগ ঝুঁকে পড়েছিল শাক্ততন্ত্রে। হতমান, সম্পত্তিহীন (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনে) জমিদার ব্রাহ্মণ ও রাজন্যবর্গ তখন কৃষ্ণের প্রতি দীন ভক্তি প্রদর্শনের চেয়ে শক্তিময়ী কালীর কাছে শরণ ও পঞ্চ ম-কারে বেশি আস্থা দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে রাজন্য বণিক ও জমিদাররা বৈষ্ণবধর্মকে একবার নতুন করে জাগাতে চেয়েছিলেন। সেই ইতিহাস জেনে নেওয়া উচিত।
সপ্তদশ শতকে খেতুরিতে যে বৈষ্ণব মহাসম্মেলন হয় সেখানে গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি ছিল বৈষ্ণব ধর্ম প্রসারের ব্যাপক প্রয়াস। বিষ্ণুপুর ও খেতুরি এই দুই কেন্দ্র থেকে ধর্মপ্রচার ও প্রসারের কাজ শুরু হয়। বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর ও খেতুরির রাজা সন্তোষ দত্ত প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যুক্ত হন। ক্রমে এগিয়ে আসেন ময়ূরভঞ্জের রাজা, পঞ্চকোটের রাজা, পাইকপাড়ার রাজা। ঝাড়িখণ্ড-উড়িষ্যা অঞ্চলে শ্যামানন্দ-শিষ্য রসিকানন্দের চেষ্টায় এগিয়ে আসেন উড়িষ্যার অনেক রাজা ও রাজন্য। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৈষ্ণবীয়ানার একটা হুজুগ উঠল। গঙ্গার এপারে বরাহনগর, আড়িয়াদহ, পানিহাটি, সুখচর, খড়দহ, কাঞ্চনপল্লী ও কুমারহট্ট এবং ওপারে মাহেশ, আকনা, বিষখানি, জিরাট, গুপ্তিপাড়া, আদি সপ্তগ্রাম জেগে উঠল নতুন বৈষ্ণব কেন্দ্ররূপে। বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রাম ছাড়াও কালনা, পূর্বস্থলী, পাটুলী, কাটোয়া, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, কুলাই, শ্রীখণ্ড, দক্ষিণখণ্ড, বীরভূমের ময়নাডাল ও মঙ্গলডিহি, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের অনেক জায়গায় তৈরি হল বৈষ্ণবী বাতাবরণ। লেখা হতে লাগল বহুতর বৈষ্ণব স্মৃতিগ্ৰন্থ, মহান্তজীবনী, পদসংকলন, বৈষ্ণব শাখা নির্ণয় ও ব্রতদিন নির্ণয়ের বই। হরিভক্তি বিলাসের নিয়মে চলল চব্বিশ ঘণ্টার ভজনসাধন কীর্তন। বৈষ্ণব গুরু ও আচার্যরা কৌলিক পদবি ত্যাগ করে সবাই নিলেন গোস্বামী পদবি। গৃহী ও সন্ন্যাসী দুরকমের বৈষ্ণবই সমাজে মান্যতা পেলেন।
ইতিমধ্যে সমাজবিবর্তনের লক্ষণ দু’ভাবে সূচিত হল। অষ্টাদশ শতকে একদিকে জাগল শাক্তধর্মের ও শাক্তগানের অভ্যুত্থান, আরেক দিকে শূদ্র সমাজে ঘটল ব্যাপক সহজিয়া যোগাযোগ। সহজিয়া ধারা এদেশে নতুন নয়। বৌদ্ধ মহাযান মতের একটা স্রোত এবং তান্ত্রিক বামাচারের ধারা আগেই ছিল লোকায়ত জীবনে। বৈষ্ণব সহজিয়া এদের ভাবধারা ও ক্রিয়াকরণ অনেকটাই নিলেন। সুফি প্রভাব ও মারফতি প্রভাব ইসলাম ধর্মেও কিছুটা বিবর্তন আনল। সত্য সংঘ, কর্তাভজা, সাহেবধনী, খুশি বিশ্বাসী এইসব হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়াত্মক গৌণ লোকধর্মগুলি জেগে উঠল গ্রামে গ্রামে। হয়তো চৈতন্যকে আদর্শ করেই প্রবর্তক-কেন্দ্রিক নানা উপধর্ম রূপ নিল। সবচেয়ে আশ্চর্য যে, সহজিয়া বৈষ্ণব নানা উপশাখা তাদের প্রবক্তা বা শাস্ত্রপ্রণেতা রূপে ব্যবহার করতে লাগল বিখ্যাত বৈষ্ণব গুরুদের নাম। নিত্যানন্দ-বীরভদ্র-নরোত্তম-কৃষ্ণদাস কবিরাজ-রূপ কবিরাজ—এইসব মহান ব্যক্তির নাম তাদের মূলধারায় জড়িয়ে নিল। এইভাবেই কি তারা চাইল তাদের শাস্ত্ৰছুট প্রকৃতিসাধনায় একরকমের বৈধতা আনতে? প্রতিবাদের গভীরে রাখতে চাইল একরকমের সহকারিতাও?
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে এককালে ছিলেন সন্ন্যাসী অথচ এখন গৃহী এমন একজন হলেন সুকান্ত মজুমদার। মঠে মন্দিরে অন্তত পনেরো বছর কাটিয়েছেন, শাস্ত্র পড়েছেন, নিয়েছেন গৈরিক বাস, কিন্তু শেষপর্যন্ত নানা কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে এসেছেন সেই পথ। তবে আচরণ তো রক্তে মেশা। বৈষ্ণব বিনয় ও নিরভিমান স্বভাব সুকান্তবাবুর মধ্যে মজ্জাগত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যাই তাঁর কাছে খটকা ঘোচাতে। সেদিন কথায় কথায় এমনই এক জিজ্ঞাসায় তাঁকে বললাম, ‘বাংলায় সহজিয়াবাদের উৎস ও প্রসার সম্বন্ধে কিছু বলুন। গোঁড়া বৈষ্ণবদের প্রতিক্রিয়াতেই কি তার ব্যাপকতা?’