তাঁর পেছন পেছন লণ্ঠনের আলোয় গিয়ে দাঁড়ালাম এজমালি বাড়ির বিরাট ছাদে। শূন্য খাঁ খাঁ ছাদ। বৈশাখী পূর্ণিমার আলোকিত রাত। শন শন হাওয়া বইছে। ফকির হাতে দিলেন পরমান্ন প্রসাদ। দীনদয়ালের নিশিভোগ। অমৃতের মতো লাগল।
ছাদের কার্নিশে বুক ঠেকিয়ে ফকির তাকালেন জ্যোৎস্নাজড়িত জলাঙ্গী নদীর জলের দিকে। চোখের দৃষ্টি সুদূর। বলতে লাগলেন: অনেকদিন থেকে আপনার মতো একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি। লক্ষ করছি মাস কয়েক আপনি এ গাঁয়ে ঘুরছেন। কখনও আমার কাছে আসেননি। রামপ্রসাদ, দ্বিজপদ মাস্টার এদের কাছে ঘুরছেন। কী আছে ওদের কাছে? কুবিরের কখানা গান? কী হবে সে গান নিয়ে? গানের মর্ম কিছু বুঝবেন? এ কি রেডিওর লোকগীতি? কিসসু বুঝবেন না যতক্ষণ না সাহেবধনী ঘরের তত্ত্ব বোঝেন। আমার কাছে সেই তত্ত্ব, সেইসব মন্ত্রের খাতা আছে। চরণ পালের বস্তু। আপনাকে সব দেব।
বৈশাখের মধ্যরাতে এমন একটা আচম্বিত প্রাপ্তি একেবারেই ভাবনার মধ্যে ছিল না, তাই বিহ্বলতায় খানিকক্ষণ কথা বেরোল না। বেশ খানিক পরে শুধু বলতে পারলাম: আমাকে দিয়ে কী কাজ হবে আপনার?
: আমার কাজ নয়, দীনদয়ালের কাজ। এ বাড়ি ভেঙে পড়ছে। দীনদয়ালের ঘরের ছাদ পড়ো-পড়ো। ভক্ত শিষ্যরা গরিব। আমার মন বলছে আপনাকে দিয়ে দীনদয়ালের প্রচার হবে। গভর্নমেন্ট হয়তো দীনদয়ালের ঘর নতুন করে বানিয়ে দিতে পারে।
: কিন্তু আপনাদের ধর্মমত তো গোপন। তার এত প্রচার কি ঠিক হবে?
: সে কথা আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু আমি আর সেবাপূজা সামাল দিতে পারছি না। প্রত্যেক বেস্পতিবারের ভোগরাগ, নিত্যপূজার খরচ, অন্ন মচ্ছবের বিরাট ব্যাপার, আসুনে ফকিরদের সম্বৎসরের হুঁকো পাটি দেওয়া, এ কি আর সম্ভব হবে? তাই ভাবছি আপনি যখন এসে গেছেন, আসলে দীনদয়াল আপনাকে পাঠিয়েছেন, তখন তাঁর কাজ তিনি করিয়ে নেবেন। চলুন, রাত হল। কাল দুপুরে আপনাকে সব দেব।
বাকি রাতটা কাটল দারুণ উত্তেজনায়। দ্বিজপদবাবুর বাইরের বারান্দায় শুয়ে ঘুম আর আসে না। কাউকে বলতেও পারছি না সামনের দিন আমি কী পেতে চলেছি। অবশেষে সকাল হল। আস্তে আস্তে সকালটা গড়িয়েও পড়ল। মচ্ছবের লোকজন দীনদয়ালের নাম করতে করতে যে যার বাড়িমুখো রওনা দিল। দুপুরে কথামতো হাজির হলাম শরৎ ফকিরের ভিটেয়। তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। বললেন, ‘এইমাত্র দীনদয়ালের ভোগ নিবেদন শেষ হল। আজ তো বিষ্যুদ্বার। আজকেই দীনদয়ালের বার। দীনদয়ালের সব আসনে আজ ভোগরাগ নিবেদন।’
আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না যে ‘আসন’ ব্যাপারটা কী? ‘আসুনে ফকির’ কথাটা, যা আগের রাতে শুনেছিলাম, তার মানেই বা কী?
শরৎ ফকির বলে চললেন: আমাদের এখানেই দীনদয়ালের মূল আসন। কিন্তু আমাদের ঘরে যারা দীক্ষা নিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সিদ্ধ তাদের বাড়িতেও আসন পাতার হুকুম দেওয়া আছে। কয়েক পুরুষ ধরে রয়েছে সে সব আসন। তারা দীক্ষা দেবারও অধিকারী। তাদের বলে আসনে ফকির। চৈতী একাদশীতে অগ্রদ্বীপে আমাদের বারুণী মেলা হয়। ওইখানে চরণ পাল বাক্সিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকে প্রত্যেক বছর অগ্রদ্বীপে দীনদয়ালের আসন পাতা হয়। আমি যাই। হাজার হাজার ভক্ত শিষ্য আসে। তিনদিন আমাদের পুজো মান্সা মচ্ছব হয়। আসুনে ফকিররা এক একটা গাছতলায় আসন পাতে। মন্ত্র দীক্ষা হয়। সামনের চোত মাসে আসুন। আমার সঙ্গে থাকবেন গাছতলায় তে-রাত্তির। কত কী দেখবেন, জানবেন। যাকগে, এবারে ভেতর বাড়িতে আসুন। আপনাকে কতকগুলো সামগ্রী দেব। কিন্তু কাউকে বলবেন না। অন্তত আমার জীবিতকালে নয়। কী, কথা দিলেন তো?
নীরবে সম্মতি জানিয়ে তাঁকে অনুসরণ করি। বুকের মধ্যে টগবগে উত্তেজনা। বাড়ির একেবারে ভেতরের মহলে ছিল এক বিশাল সিন্দুক। বিরাট এক চাবি দিয়ে তা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুললেন ফকির। ভেতরে হাত ডুবিয়ে লাল শালুতে মোড়া কী সব বেরোল। তাতে মাথা ঠেকিয়ে খুলে ফেললেন শালুর আবরণ। বেরোল কতকগুলি কালজীর্ণ পুঁথি আর খাতা। হলদে কাগজ। তাতে ভুষো কালির উজ্জ্বল হস্তাক্ষর। ‘এইগুলোতে আমাদের ঘরের সব গুহ্য খবর আছে। আর এই নিন আসল পুঁথি।’
থরথর উত্তেজনায় হাতে নিলাম একটা পুঁথি। আদ্যন্ত লাল কালিতে লেখা সাহেবধনী ঘরের গুপ্তমন্ত্র আর সাধনরীতি।
ফকির বললেন: এই হল সাহেবধনী ঘরের সত্য মন্ত্র আর গুপ্তনাম। একজন মুসলমান নারী উদাসীন এ মন্ত্র আর আমাদের ঘরের শিক্ষা দেন। এগুলো আচরণমূলক। এর সমস্ত শিক্ষা পুরো জানতেন চরণ পাল। তাঁর ছেলে ছিলেন তিলক। তিলকের ছেলে ফটিক। ফটিকের চার ছেলে—রামভদ্র, বীরভদ্র, প্রাণভদ্র আর মনমোহন ভদ্র। সেই রামভদ্রের বড় ছেলে আমি। এ সব খাতা পুঁথি শিক্ষা পাঁচপুরুষ পেরিয়ে আমার হাতে পড়েছে। খুব গুপ্ত সাধনা আমাদের। মাটির কার্য, নালের কার্য, করোয়া সাধন। এ সব আপনাকে আমি বুঝিয়ে দেব। কুবিরের গানে আমাদের ঘরের তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা আছে। তার বাইরের অর্থ আর ভেতরের কথা আলাদা।
আমি চোখ বোলাতে লাগলাম অদ্ভুত ভাষায় লেখা সে সব মন্ত্রে, বিড় বিড় করে পড়তে লাগলাম:
আল্লাতালা ব্ৰহ্মসাঁই তোমার নেহার ধরে
মাটির বস্তুকে পান করিলাম।
ক্লিং মন্ত্র অনঙ্গ মুঞ্জরী হিঙ্গলবরণ গা হরিতেল বরণে সাধি।