আমি ভাবছি লোকগুলো বুঝি হরিধ্বনি দিচ্ছে। দ্বিজপদবাবু ভুল ভাঙিয়ে জানালেন, ‘সাহেবধনীদের উপাস্যের নাম দীনদয়াল। এদের সম্প্রদায়কে বলে দীনদয়ালের ঘর। কখনও কখনও দীনদয়ালকে এরা দীনবন্ধুও বলে। এটা ওদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ।’
তা হলে সেদিন কুবিরের গানে যে শুনেছিলাম ‘ওরে বৃন্দাবন হতে বড় শ্রীপাট হুদাগ্রাম/ যেথা দিবানিশি শুনি দীনবন্ধু নাম’—সে তা হলে এই দীনদয়াল-দীনবন্ধু। ক্রমে জানা গেল দীনদয়ালের ঘরে হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান সমান। মচ্ছবের সময় দেখলাম যে হিন্দুকে পরিবেশন করছে মুসলমান, মুসলমানকে হিন্দু। আসলে গেরুয়া বা কোনও বর্হিবাস তো পরে না। গৃহী ধর্ম। যে কেউ নিতে পারে। আমাদের সাদা চোখে যাকে হিন্দু বা মুসলমান ভাবছি তারা কিন্তু এখানে বর্ণ হিন্দু বা শরিয়তি মুসলিম নয়। সকলেই সাহেবধনী। ততক্ষণে জহরালি নেচে নেচে গাইছে:
এই ব্রজধামের কর্তা যিনি
সেই ধনী এই সাহেবধনী।
রাইধনী এই সাহেবধনী॥
আশ্চর্য তো! ব্রজের রাইকে এরা সাহেবধনী বানিয়েছে। তার মানে এরা নারীভজা-সম্প্রদায়। এদিকে ছামেদ আলি গান ধরেছে:
একের সৃষ্টি সব পারি না পাকড়াতে।
আল্লা আলজিহ্বায় থাকেন আপনসুখে
কৃষ্ণ থাকেন টাকরাতে।
এ সবই নাকি কুবিরের গান। আশ্চর্য সমন্বয়বাদের গান। এ গানের মূল তো দেখতেই হবে।
পাশ থেকে ধারাবিবরণীর মতো দ্বিজপদ মাস্টারমশাই বলে যাচ্ছেন: চরণ পালের প্রধান শিষ্য ছিলেন তিনজন। রুকুনপুরের প্রহ্লাদ গোঁসাই, বামুনপুকুরের রামচন্দ্র গোঁসাই আর এই হুদোর কুবির গোঁসাই। এদের মধ্যে গান লিখেছে শুধু কুবির। আহা কী গান!
জানতে চাইলাম: কুবিরের গানের শিষ্য নেই?
: সে কী? আপনি যাদুবিন্দুর গান শোনেননি? এখুনি শুনিয়ে দিচ্ছি। মস্ত বড় ভাবের কবি। কুবিরের প্রধান শিষ্য যাদুবিন্দু গোঁসাই। বাড়ি ছিল বর্ধমানের পাঁচলখি গ্রাম। সে বাড়ি এখনও আছে। ওই দেখুন যাদুবিন্দুর দৌহিত্রের ছেলে দেবেন গোঁসাই। ও দেবেন, বলি এদিকে এসো।
বিনীত হেসে হাত জোড় করে দেবেন গোঁসাই এসে দাঁড়ালেন। শীর্ণ চেহারায় টকটকে ফর্সা রং। বাবরি চুল। সাদা পাঞ্জাবি পরনে। জিজ্ঞেস করলাম: আপনাদের পাঁচলখি গ্রামটা কোথায়?
: আজ্ঞে, নবদ্বীপের হিমায়েৎপুর মোড় থেকে বর্ধমান যাবার রাস্তা। সেই রাস্তায় নাদনঘাট ছাড়িয়ে ধাত্রীগ্রামের আগে নাদাই ব্রিজ। তারই গায়ে আমাদের পাঁচলখি। একদিন যাবেন তো?
: কী দেখব সেখানে?
: যাদুবিন্দুর সমাধি আছে আর তাঁর গানের খাতা। শত শত গান।
দ্বিজপদ বললেন: ওহে দেবেন্দ্র, গোপালের মাকে ডাকো তো। এঁকে একখানা যাদুবিন্দুর গান শোনাব।
দেবেন্দ্র সেই ভিড়ে পথ খুঁজতে লাগলেন। দ্বিজপদবাবুকে সেই ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: যাদুবিন্দু আবার কীরকম নাম? যাদবেন্দ্রের স্বরসঙ্গতি নাকি?
: আরে না না, যাদু আর তার সাধনসঙ্গিনী বিন্দু, এই দুইয়ে মিলিয়ে যাদুবিন্দু। ওই একখানা গানে আছে শুনেছেন, ‘সর্বচরণে পাপীর এই নিবেদন’ তার মধ্যে আছে, ‘যাদু বিন্দু এরাই দুজনা/পাঁচলখি গাঁয় তার ঠিকানা’। এবারে বুঝলেন তো যাদুবিন্দু নামরহস্য?
ইতিমধ্যে এসে গেল গোপালের মা! মধ্যবয়সী বিধবা। খুব লজ্জা পেয়ে গেছেন। ‘আমি কী গান করব বলো দিনি বাবা? আমার কি আর সে গানের গলা আছে?’
দ্বিজপদ বললেন, ‘যা আছে ওতেই চলবে, নাও ধরো।’ আমাকে বললেন: কুবিরের পোষ্যপুত্র কেষ্টদাস। এ তারই ছেলের বিধবা। বুড়ির গলা খুব মিঠে। যাদুবিন্দুর সঙ্গে এর খুব ভাব ছিল। যাদুবিন্দুর অনেক গান এর জানা আছে।
গোপালের মা মধুর কণ্ঠে গান ধরল:
যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই সেই ভাবেতেই থাকি
অধিক আর বলবো কি?
তুমি খাও তুমি খিলাও
তুমি দাও তুমি বিলাও
তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি।
গুরু দুখ দিতে তুমি সুখ দিতেও তুমি
কুনাম গুনাম সুনাম বদনাম সবই তোমারই
ও কুল্ আলম্ তোমারই ও কুদরতবিহারী
তুমি কৃষ্ণ তুমিই কালী তুমি দিলবারি।
কখনও দুগ্ধ চিনি ক্ষীর ছানা মাখন ননী
কখনও জোটে না ফ্যান আমানি
কখনও আ-লবণে কচুর শাক ভখি।
কহিছে বিন্দু যাদু তুমি চোর তুমিই সাধু
তুমি এই মুসলমান এই হিঁদু
তাই তোমারে কুবিরচাঁদ বলে ডাকি॥
গানের পরে গান। কখনও ‘আমার কাদা মাখা সার হলো’, কখনও ‘যাসনে মন বাঁকানদীর বাঁকে’ গোপালের মা গেয়ে যায়। তার দু’চোখ ভরা জল।
সকলের অলক্ষে গানের আসর থেকে আবছা অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ি। এবারে চরণ পালের বাস্তুভিটার ভেতরে। আমাকে দেখতে পেয়ে চরণ পালের বংশের তখনকার কর্তা শরৎ ফকির নেমে আসেন—‘আসুন আসুন, আপনার খবর পেইছি। ভেতরে উঠে আসুন, দীনদয়ালের আসন দেখবেন।’
একটা পুরানো পঙ্খের কাজ করা দালান। তার মধ্যে প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠ। বাইরে অন্তত একশো পুরুষ আর নারী ভক্ত মানসিক করে হত্যে দিয়ে আভূমি প্রণত। প্রকোষ্ঠের ভেতরে টিমটিম করে জ্বলছে প্রদীপ। অনেকক্ষণ ঠাওর করে চোখে পড়ে একটা ত্রিশূল, চিমটে, পিঁড়ে আরও যেন কীসব।
‘দণ্ডবত করুন’, শরৎ ফকির কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাদের বংশের বাইরে কেউ কখনও দীনদয়ালকে দেখেনি। আপনি সেই সুযোগ পেলেন।’
আবেগের তাৎক্ষণিকতায় চোখ বুঁজে গেল। ভাবলাম আমার মতো জ্ঞানপাপী অভাজনদের প্রতি এত কৃপা! শরতের চোখ অবনত। হাত বদ্ধমুষ্টি। তাতে ফকিরি দণ্ড। যেন প্রত্যাদেশের মতো বললেন: আমার সঙ্গে আসুন।