ষাটের দশকের শেষে আমি যখন উপধর্ম সম্পর্কে খোঁজ করতে শুরু করি তখন বিদ্যাভূষণের পদ্ধতিই শ্রেয়তর মনে হল। এ লেখার পরবর্তী অংশ সেই পায়ে-হাঁটা, চোখে-দেখা আর কানে-শোনার সত্য বিবরণ। এতে আছে লৌকিক উপধর্মের সেই পরাক্রান্ত স্বরূপ, সভ্যতা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-শাস্ত্র-নিপীড়ন যাকে আজও মারতে পারেনি।
*
‘সাহেবধনী’ কথাটা কোনওদিন শুনিনি। এই বিশাল জনপদে যে বৃত্তিহুদা বলে একটা গ্রাম আছে, এ ব্যাপারটাও ছিল অজানা। মফস্বলের এক কাগজে একজনের ধারাবাহিক লেখা পড়ে জানতে পারি নদীয়ায় গত শতকে কুবির সরকার বলে এক বড় লোকগীতিকার ছিলেন। নিবন্ধে ব্যবহৃত তাঁর গানের উদ্ধৃতি দেখে মনে হল কুবিরের গান সংগ্ৰহযোগ্য। চিঠিতে যোগাযোগ করে একদিন হাজির হলাম নদীয়ার চাপড়া থানার বৃত্তিহুদা গ্রামে। সেখানেই রামপ্রসাদ ঘোষের বাড়িতে স্বচক্ষে দেখলাম তাঁর ঠাকুর্দা রামলাল ঘোষের অনুলিখনে কুবির গোঁসাইয়ের ১২০৩ খানা গান। পরে তাঁরা উৎসাহ করে দেখালেন কুবির গোঁসাইয়ের সমাধি মন্দির, সেখানে তাঁর স্ত্রী ভগবতী আর সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণমোহিনীর সমাধিও রয়েছে। উঁকি মেরে কুবিরের সমাধি ঘরে দেখলাম একটি মাটির ঢিবি, একটি সজ্জিত চৌকি ও বিছানা, ফুলের সাজি, ফকিরী দণ্ড, বাঁকা লাঠি, ত্রিশূল, খড়ম আর কাঠের পিঁড়ি।
: এ সব তেনার ব্যবহার করা জিনিস, বললে গোপালদাস। এখানকার সেবাইত। কুবিরের অধস্তন চতুর্থ স্তরের বংশধর।
কখনও সহজিয়া বৈষ্ণবদের সমাধি তো দেখিনি। কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করলাম মাটির ওই উঁচু ঢিবিটা কেন?
: ওইখানে রয়েছে তেনার মাথা। জানেন তো আমাদের সমাধি হয় মাটি খুঁড়ে তাতে শরীরকে হেলান দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসিয়ে।
আরও জানা গেল, ওই রামলালের খাতা থেকেই, যে কুবিরের জন্ম ১১৯৪ বঙ্গাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায়, মৃত্যু ১২৮৬-র ১১ আষাঢ় মঙ্গলবার রাত চারদণ্ডে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথির মধ্যে। এবারে তাঁরা দেখালেন কুবিরের গুরু চরণ পালের ভিটে। সবই দেখা হল। শুধু বোঝা গেল না ১২০৩ খানা গানের লেখক কুবির গোঁসাইয়ের নাম কেন সর্বসাধারণের কাছে এতটা অজ্ঞাত।
বাড়ি ফিরে বিদ্যুচ্চমকের মতো দুটো ব্যাপার চোখের সামনে ধরা পড়ল কয়েক মাসের মধ্যে। প্রথমত, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়তে পড়তে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম প্রসিদ্ধ গান ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’ কুবিরের লেখা। দ্বিতীয়ত, ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১৮৭০) পড়ার সময় চোখ পড়ল ‘সাহেবধনী’ সম্প্রদায় সম্পর্কে। এই সম্প্রদায়ের স্রষ্টা দুঃখীরাম পাল। তাঁর পুত্র ‘চরণ পাল এই সম্প্রদায়ের মত বিশেষরূপে প্রচার করিয়া অতিশয় বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছেন।…কিছুদিন হইল চরণ পালের মৃত্যু হইয়াছে।’
আরও দু-একবার নিজে নিজে বৃত্তিহুদা গ্রামে ঘুরে বুঝলাম জলাঙ্গী নদীর পশ্চিম পাড়ে দোগাছিয়া গ্রাম, পুবে বৃত্তিহুদা। চরণের পিতা ছিলেন দোগাছিয়ার মানুষ। জনৈক উদাসীনের কাছে তিনি দীক্ষা নেন এবং গড়ে ওঠে সাহেবধমী ধর্মমত। তাঁর ছেলে চরণ পাল দোগাছিয়া থেকে বাস্তু তুলে আনেন পরপারে বৃত্তিহুদায়। এখানেই সাহেবধনীদের সাধনপীঠ আর আসন। চরণের শিষ্যদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কুবের সরকার, জাতে যুগী, পেশায় কবিদার। চরণের কাছে দীক্ষা নিয়ে কুবের হলেন গোঁসাই, বনে গেলেন তাত্ত্বিক গীতিকার। আর নদীয়ার নিজস্ব স্বরসঙ্গতির নিয়মে কুবেরের উচ্চারণ হল কুবির। একজন গায়ক কুবিরের গান শোনালেন। সযত্নে টুকে নিলাম:
ওরে বৃন্দাবন হতে বড় শ্রীপাট হুদা গ্রাম
যথা দিবানিশি শুনি দীনবন্ধু নাম।
হেরি নীলাচলে যেমন লীলে
এখানে তার অধিক লীলে
হিন্দু যবন সবাই মিলে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।
দ্যাখো গোঁসাই চরণচাঁদ আমার
বসিয়েছে চাঁদের বাজার
ভক্তবৃন্দ আসছে যাচ্ছে অবিশ্রাম।
আমার চরণচাঁদের নামের জোরে
কত দুখী তাপী পাপী তরে
হাঁপ কাশি শূল গুড়ুম ব্যথা
মহাব্যাধি হয় আরাম ॥
গানের শেষ স্তবক বেশ লক্ষণীয়। চরণ পালের তা হলে ভেষজবিদ্যায় বেশ হাতযশ ছিল। সাহেবধনী মতে হিন্দু যবন যে সমান মর্যাদায় রয়েছে তা বুঝতে দেরি হল না। পরিসংখ্যান ঘেঁটে আদমসুমারি মাফিক এইরকম বিবরণ তৈরি করা গেল—
গ্রামের নাম: বৃত্তিহুদা। থানা: চাপড়া। জেলা: নদীয়া। অবস্থান: কৃষ্ণনগর শহর থেকে ১৬ মাইল উত্তর-পূর্বে। মৌজা নং ২৯। অধিবাসীদের জীবিকা: কৃষিকর্ম, ব্যবসায় ও শিক্ষকতা। মোট জনসংখ্যা ৩৪৫০ জন। মুসলমান ৫২৫ ঘর। ঘোষ ৬০ ঘর। কর্মকার ৮ ঘর। দাস ৪০ ঘর। প্রামাণিক ৬ ঘর। গড়াই ১০ ঘর। সূত্রধর ১ ঘর।
যে গ্রামে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সেখানে বৈষ্ণব সহজিয়াকেন্দ্রিক একটা উপধর্ম কীভাবে টিকে আছে বিপুল গৌরবে তা জানতে ইচ্ছে হল। গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের হেডমাস্টার দ্বিজপদ প্রামাণিক বললেন বৈশাখী পূর্ণিমায় আসতে। ওই দিন চরণ পালের ভিটেয় মহোৎসব হবে।
গেলাম সেই মহোৎসবে। দেখলাম বৃত্তিহুদা আর আশপাশের অনেক কটা গ্রামের মানুষ বিপুল উৎসাহে মেতে উঠেছে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে। তবে উচ্চবর্ণের কেউ যে নেই সেটাও চাক্ষুষ হল। সন্ধের পর সারারাত চলল শব্দগানের আসর। লালনের ‘দৈন্যতা’র গানের জবাবে কুবিরের ‘প্রবর্ত’ গান অনেকগুলি শোনার সুযোগ হল। দেখলাম কবিরের গান বেশিরভাগ গাইছে মুসলমান ফকির। জহরালি আর ছামেদ আলি। লোকে গানের ফাঁকে ফাঁকে হুংকার দিয়ে উঠছে: ‘জয় দীনদয়াল জয় দীনবন্ধু।’