ইসলাম কিভাবে বাঙালীর জীবনে সার্থকতা লাভ করবে, তার সন্ধান যতটুকু পাওয়া যাবে বাংলার এই মারফৎ-পন্থীর কাছে, ততটুকুও পাওয়া যাবে না বাংলার মওলানার কাছে, কেননা, সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও মারফৎ-পন্থীর ভিতরে রয়েছে কিছু জীবন্ত ধর্ম, সৃষ্টির বেদনা, পরিবেষ্টনের বুকে সে এক উদ্ভব; আর মওলানা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভাণ্ডারী—সম্পর্কশূন্য ছন্দোহীন তাঁর জীবন।
এই মারফৎ-পন্থীর বিরুদ্ধে আমাদের আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের শক্তিপ্রয়োগ করেছেন, আপনারা জানেন।…আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সব চাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তাঁরা করেননি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে লাঠির জোরে তাঁরা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ দেশে মারফৎ-পন্থীদের সাধনার পরিবর্তে যদি একটি বৃহত্তর পূর্ণতর সাধনার সঙ্গে বাংলার যোগসাধনের চেষ্টা আমাদের আলেমদের ভিতরে সত্য হ’তো, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে শুধু বাউল ধ্বংস আর নাসারা দলন ফতোয়াই পেতাম না।
প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই দলন পীড়ন বাউল-দরবেশ-ফকিরদের দুর্বল ও দলছুট করে দিলেও একেবারে লুপ্ত করে দিতে পারেনি। কারণ নিচুসমাজের মানুষ অসাম্প্রদায়িকভাবে গ্রাম্যসমাজে সহজে মিলতে মিশতে পারে। খোঁজ করলে দেখা যাবে অখণ্ড বাংলায় যত উপধর্ম সম্প্রদায় গজিয়ে উঠেছিল তাদের বেশির ভাগ প্রবর্তক একজন মুসলমান অথবা হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে। কর্তাভজাদের স্রষ্টা আউলেচাঁদ একজন মুসলমান আর তাঁর প্রধান শিষ্য রামশরণ পাল একজন সদগোপ। সাহেবধনী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক একজন মুসলমান উদাসীন এবং এ ধর্মের প্রধান সংগঠক চরণ পাল জাতে গোয়ালা।
আসলে বাংলার লৌকিক উপধর্মগুলির ভিত্তিতে আছে তিনটি প্রবর্তনা—মুসলমান বাউল ফকির দরবেশদের প্রত্যক্ষ প্রভাব, শোষিত শূদ্রবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবিরোধ এবং লোকায়ত বৈষ্ণব ধর্মের উদার আহ্বান। এই শেষ বিষয়টির একটি সামাজিক ব্যাখ্যা দরকার।
শ্রীচৈতন্য আমাদের দেশে এসেছিলেন এক সময়োচিত ভূমিকায় পরিত্রাতার রূপে। তখন ষোড়শ শতকে শাসক মুসলমানের ব্যাপক হিন্দু ধর্মান্তরকরণ রুখতে এবং শূদ্রবর্ণের উপর আচারমার্গী শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ঠেকাতে তিনি এক উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্মের পরিকল্পনা নেন। তাঁর ধর্মসাধনের সরলতম পন্থা ছিল ‘হরেনামৈব কেবলম্।’ এক বিপুল জনসন্নিবেশ বৈষ্ণব ধর্মকে বেগবান করে তোলে। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরেই বৈষ্ণবধর্মে ভেদবাদ জেগে ওঠে। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ লিখে চৈতন্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর লোকশিক্ষা আর সাধারণ মানুষের সংরক্ষণের দিকটি হল উপেক্ষিত। সাধারণ বৈষ্ণব মানুষ আর তাদের মুক্তিদূত শ্রীচৈতন্যের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রাশি রাশি শাস্ত্র আর পুঁথি। অসহায় শূদ্ররা তখন ভ্রষ্টাচারে মগ্ন হল। সেই সংকটকালে নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র আরেকবার নেতা আর ত্রাতারূপে দেখা দিলেন। পলাতক ভ্রষ্টাচারী বৌদ্ধ সহজিয়া, মৈথুন সাধক মূর্খ তান্ত্রিক আর অজ্ঞ মুমুক্ষু মানুষদের বীরভদ্র আবার বৈষ্ণব করলেন। এবারকার বৈষ্ণবায়নে এল নানা লৌকিক গুহ্য সাধনা, নিশ্বাসের ক্রিয়া ও গোপন জপতপ। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল নতুন নতুন আখড়া ও শ্রীপাট। গঙ্গার ধারে ধারে পাটুলী কাটোয়া অগ্রদ্বীপ ধরে আস্তানা পাতল সহজিয়া বৈষ্ণবরা। বীরচন্দ্রকে তারা দেখল চৈতন্যের অবতার রূপে। নতুন নেতার জয়ধ্বনি দিয়ে তারা ঘোষণা করল নতুন বাণী:
বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌর অবতার।
যে না দেখেছে গৌর সে দেখুক এবার॥
কালক্রমে লোকগুরুরা গীতার ‘যদাযদাহি ধর্মস্য’ শ্লোকটি সামনে রেখে এমন একটা স্বতঃসিদ্ধ বানিয়ে ফেললেন যাতে নির্জিত শোষিত মানুষরা বিশ্বাস করে নিল কৃষ্ণের অবতার গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গের অবতার বীরচন্দ্র। এই সূত্র অনুসরণ করে আমরা সকৌতূহলে দেখতে পাই কর্তাভজা ধর্মের প্রথম দিকের ঘোষণা ছিল: ‘কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলেচন্দ্র/তিনেই এক একেই তিন’। তার মানে বীরচন্দ্র সরে গিয়ে এলেন আউলেচন্দ্র। তৈরি হল বৈষ্ণববিশ্বাসী এক নতুন উপধর্ম। অচিরে সেই উপধর্ম অর্থাৎ কর্তাভজাদের নেতৃত্বে এলেন দুলালচন্দ্র পাল, যাঁর মা-র (মূল নাম সরস্বতী) নতুন নামকরণ হল সতী মা। সতী মা নামে শচী মা ধ্বনির আভাস তো স্পষ্ট। এর গায়ে গায়ে তৈরি হল নতুন উচ্চারণ:
তিন এক রূপ।
শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র শ্রীগৌরচন্দ্র ও শ্রীদুলালচন্দ্র
এই তিননাম বিগ্রহস্বরূপ॥
কেমন সুপরিকল্পিতভাবে আউলেচন্দ্রকে সরিয়ে দুলালচন্দ্র লোকমানসে আসন পাতলেন।
একশো বছর আগে অক্ষয়চন্দ্র দত্ত যখন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি লেখেন তখন বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের হদিশ দেন এবং একটা মোটামুটি প্রতিবেদন খাড়া করেন। মুশকিল যে, অক্ষয়কুমার নিজে সরেজমিন খুঁজে পেতে ঘুরে প্রতিবেদন লেখেননি। মোটামুটি খবর এর-তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে লিখেছিলেন। তাতে ভুল আছে, খণ্ডতা আছে। বরং অনেকটা ঘুরে বিবরণ লিখেছিলেন বিদ্যাভূষণ যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘Hindu Castes and Sects’ বই লেখার সময়। মেহেরপুরের বলরামী সম্প্রদায়ের বিবরণ অক্ষয়কুমার নিতান্ত রৈখিকভাবে দিয়েছেন, অথচ বিদ্যাভূষণ স্বয়ং মেহেরপুরে গিয়ে বলরামের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তবে লেখেন।