আমি বলেছিলাম: হ্যাঁ। নালের কাজও বুঝি।
আমার দ্বিতীয় কথাটিতে কাজ হল খুব। তখন বাউল আরও অনেক কথা আমাকে জানিয়ে দিল।
লোকধর্মের গুপ্ত ঘরানায় তার মানে, আলাদা কতকগুলি ‘বন্দিশ’ আছে। তার কেতা সহবৎ না জানা থাকলে ওস্তাদ মুখ খুলবেন না। লোকধর্মের ‘আস্লি চিজ’ সংগ্রহ করা কঠিন, আবার সময় বিশেষে খুব সহজ। আমার এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন মারফতি ফকিরদের মূল রহস্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলাম।
সেবার শেওড়াতলার মেলায় প্রায় নিশিরাতে দুই ফকিরের তত্ত্ব আলোচনা শুনছিলাম। অম্বুবাচীর ক্ষান্তবর্ষণ রাত। জাহান ফকির আর শুকুর আলি কথা বলছিলেন। আমি চুপ করে শুনছিলাম। পরে দিনের আলো ফুটতে জাহান ফকিরের সঙ্গে আলাপ হল। বাড়ি বর্ধমানের সাতগেছিয়ায়। লেখাপড়ার হিসাবে প্রায় মূর্খ। একেবারে গরিব। পোশাক-আশাক আলখাল্লা তেমনই মলিন। কিছুতেই আমার কাছে মন খুলবে না। কেবল ধানাই পানাই। শেষকালে চটিয়ে দেবার জন্যে বলে বসলাম: আপনারা তো বেশরা। শরিয়ত একেবারে বাদ দিয়ে, ভুলে গেলে, তবে কি মারফতি কবুল হবে?
মুখচোখ প্রথমে ব্যথায় ভরে উঠল। তারপর হঠাৎ সত্যের ঝিলিকের মতো আলো খেলে গেল মুখে। আস্তে আস্তে জাহান বললেন: আপনি পণ্ডিত লোক, এ সব কী বলছেন? শরিয়ত ভুলে মারফত! আচ্ছা বাবু, আপনি তো প্রথমে বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ পড়েছেন, তারপরে তো দ্বিতীয়ভাগ? তা হলে কি আপনি প্রথমভাগ ভুলে গেছেন?
বিদ্যুচ্চমকের মতো কথা এবং লেখাপড়া বিষয়ে মূর্খ লোকের মুখে! আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে রইলাম। চকিতে বুঝলাম শরিয়ত হল means আর মারফত হল end। সাহস পেয়ে বললাম: আপনারা শাস্ত্র মানেন না বুঝলাম। জাতি মানেন না কেন? তার যুক্তি কী?
খুব ধীর কণ্ঠে গুনগুন করে জাহান গাইতে লাগল:
বামুন বলে ভিন্ন জাতি
সৃষ্টি কি করেন প্রকৃতি?
তবে কেন জাতির বজ্জাতি করো এখন ভাই।
বল্লাল সেন শয়তানি দাগায়
গোত্র জাত সৃষ্টি করে যায়
বেদান্তে আছে কোথায় আমরা দেখি নাই।
বেশ ভাল লাগল। মন ভরে উঠল। জাহান যেন বেশ মেজাজ পেয়ে বলে যেতে লাগলেন আপনমনে: শাস্তর মানুষ তৈরি করেছে। জাতও মানুষ তৈরি করেছে। হিন্দুদের মধ্যে বামুন কায়েত, মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ খোন্দকার এ সব বড় রটালে কে? আমাদের দুদ্দুর গানে বলে:
অজ্ঞ মানুষে জাতি বানিয়ে
আজন্ম ঘুরিয়া মরে স্বজাতি খুঁজিয়ে॥
শিয়াল কুকুর পশু যারা
এক জাতি এক গোত্র তারা
মানুষ শুধু জাতির ভারা মরে বইয়ে॥
সেই জন্যেই আমরা সত্যিকারের মানুষ খুঁজি। সে মানুষ বৈধিকে নেই, শরায় নেই, শালগ্রাম শিলায় নেই—নোড়ায় নেই, মন্দিরে মসজিদে নেই। যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।
আমি বললাম: তা হলে উচ্চবর্ণ বাতিল? শাস্ত্র কোরান খারিজ?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের কাছে বাতিল। আপনারা থাকুন আপনাদের জাতিত্ব নিয়ে, শাস্তর আউড়ে, মৌলবী আর বামুনের বিধান মেনে। আমরা জাতি মানিনে। আমরা বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষের মধ্যে, দীনদরিদ্রের মধ্যে আছেন দীনবন্ধু। শুনুন এই গান:
ছোট বলে ত্যাজো কারে ভাই
হয়তো ওর রূপে এলেন ব্রজের কানাই।
শূদ্র চাঁড়াল বাগদি বলার দিন
দিনে দিনে হয়ে যাবে ক্ষীণ
কালের খাতায় হইবে বিলীন দেখছি রে তাই॥
এ গানের ভবিষ্যৎ-বাণী আজকে প্রায় সত্য। শূদ্র চাঁড়াল বাগদি বলার দিন সত্যিই শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু এ সব গানে যে প্রতিবাদ, যে রুখে দাঁড়ানো, তার মধ্যেও একটা জাতিত্বের নেশা আছে।
বেদ কোরান পুরাণ ব্রাহ্মণ মৌলবী মন্দির মসজিদ বৈধী সাধনা সবকিছু খারিজ করতে করতে আঠারো শতকের শেষদিকে আমাদের এই বাংলায় যত উপধর্ম জেগে উঠেছিল তার তালিকা বিচিত্র ও রোমাঞ্চকর ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইয়ে উদ্ধৃত সেই তালিকা এই রকম: বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনীপন্থী, সহজিয়া, খুশিবিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ, বিত্থলভক্ত, কর্তাভজা, স্পষ্টদায়িক বা রূপ কবিরাজী, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই, পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পনারায়ণী, বড়ী, অতিবড়ী, রাধাবল্লভী, সখিভাবুকী, চরণদাসী, হরিশ্চন্দ্ৰী, সাধনপন্থী চুহড়পন্থী, কুড়াপন্থী, বৈরাগী, নাগা, আখড়া, দুয়ারা, কামধেন্বী, মটুকধারী, সংযোগী, বার সম্প্রদায়, মহাপুরুষীয় ধর্মসম্প্রদায়ী, জগমোহনী, হরিবোলা, রাতভিখারী, বিন্দুধারী, অনন্তকুলী, সৎকুলী, যোগী, গুরুদাসী বৈষ্ণব, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, গোপ বৈষ্ণব, নিহঙ্গ বৈষ্ণব, কালিন্দী বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, হরিব্যাসী, রামপ্রসাদী, বড়গল, নস্করী, চতুর্ভুজী, ফারারী, বাণশয়ী, পঞ্চধুনী, বৈষ্ণব তপস্বী, আগরী, মার্গী, পল্টুদাসী, আপাপন্থী, সৎনামী, দরিয়াদাসী, বুনিয়াদদাসী, অহমদ্পন্থী, বীজমার্গী, অবধূতী, ভিঙ্গল, মানভাবী, কিশোরীভজনী, কুলিগায়েন, টহলিয়া বা নেমো বৈষ্ণব, জোন্নী, শার্ভল্মী, নরেশপন্থী, দশামার্গী, পাঙ্গুল, বেউড়দাসী, ফকিরদাসী, কুম্ভপাতিয়া, খোজা, গৌরবাদী, বামে কৌপীনে, কপীন্দ্র পরিবার, কৌপীনছাড়া, চূড়াধারী, কবীরপন্থী, খাকী ও মুলুকদাসী।
এত উপধর্ম সম্প্রদায় ছিল এ দেশে? তারা গেল কোথায়? সম্ভবত উনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন, মিশনারিদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এইসব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে। একদিকে উচ্চ ধর্মাদর্শ আরেকদিকে কট্টর মুসলমানদের সক্রিয় দমননীতি বাউল ফকিরদের ধ্বংস করে দিল অনেকটা। শ্রীরামকৃষ্ণ তো এ সব লোকায়ত ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বললেন: বাড়িতে ঢোকার দুটো পথ—সদরের খোলা দরজা আর পায়খানা দিয়ে ঢোকা। সদর দিয়ে ঢোকাই ভাল, পায়খানা দিয়ে ঢুকলে গায়ে নোংরা লাগা স্বাভাবিক। তাঁর মতে কামিনীকাঞ্চনের সাধনা বিপজ্জনক।