কর্তাভজা সম্প্রদায় সর্বজাতের মিলনক্ষেত্র রচনায় দুলালচাঁদ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র জাতীয় চারিটি কন্যাকে বিবাহ করেন। চারিটি স্ত্রীর গর্ভে পাঁচটি পুত্রসন্তান হয়।
কর্তাভজাদের সম্পর্কে সাহেবদের উৎসাহ ও সতর্কতা লক্ষ করবার মতো। কেরি, মার্শম্যান ও ডাফসাহেব খুব নজর রাখতেন ঘোষপাড়ার দিকে।* ১৮১১ সালে ডব্লিউ. ওয়ার্ড দুলালের জীবিতকালে যে প্রতিবেদন লিখে গেছেন তাতে বলেছেন:
Doolalu, the son, pretends that he has now 400000 disciples spread over Bengal.
ওয়ার্ড অবশ্য ১৮১৮ সালে তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে এই চার লক্ষ শিষ্যসংখ্যা কমিয়ে এনেছেন কুড়ি হাজারে।
রয়েল ফকিরের দলের সঙ্গে আমি যখন ঘোষপাড়ায় যাচ্ছিলাম তখন তার দলবল গাইছিল এক আশ্চর্য কোরাস:
দিলে সতীমায়ের জয় দিলে কর্তামায়ের জয়
আপদখণ্ডে বিপদখণ্ডে খণ্ডে কালের ভয়।
দিলে মায়ের দোহাই ঘোচে আপদ বালাই
ছুঁতে পারে না কাল শমনে।
এই সতী মা যে কেমন করে ক্রমে ক্রমে কর্তা মা হয়ে উঠেছিলেন সেও এক রহস্য। কেননা ১৮১১ সালে এবং ১৮২৮ সালে ওয়ার্ড সাহেব এবং পরে হোরেস হেম্যান্ উইলসন তাঁদের লেখায় রামশরণ ও দুলালচাঁদের সুবিস্তৃত উল্লেখ বারবার করলেও এক জায়গাতেও সতী মা-র কথা লেখেননি। বরং ওয়ার্ড সাহেব ঐশীক্ষমতা ও রোগ আরোগ্যের মিথ তৈরি করেছেন আউলচাঁদ ও রামশরণের নামে। আউলচাঁদ সম্পর্কে বলেছেন: ‘It is pretended he communicated his supernatural powers’ এবং রামশরণ পাল সম্পর্কে, ‘He persuaded multitudes that he could cure leprosy and other diseases’। এই রোগারোগ্যের কৌশলে অসহায় মানুষকে ঠকিয়ে রামশরণ যে বিপুল অর্থ সম্পত্তি বানিয়েছিলেন ওয়ার্ড সে ইঙ্গিত গোপন রাখেননি। তাঁর মতে ‘By this means, from a state of deep poverty he became rich and his son now lives in affluence’।
সমস্যাটা এইখানে। রোগ সারাবার গল্প কিংবা কল্পকাহিনীগুলি সতী মা-র নামে রটল কেমন করে? ‘সহজতত্ত্ব প্রকাশ’ নামে একটা বইয়ে সমস্যাটার জবাব আছে। মনুলাল মিশ্র নামে এক কর্তাভজা এ বইয়ে লেখেন:
তাঁহার [অর্থাৎ রামশরণ] তিরোধানের পর মহাত্মা দুলালচাঁদের চেষ্টায় সুষ্ঠুভাবে প্রচারিত সতী মায়ের অলৌকিক শক্তির কাহিনী কর্তাভজন ধর্মকে জগতে প্রচারিত হইতে সাহায্য করিয়াছিল।
রয়েল ফকিরের তো এ সব কথা জানা নেই। সে শুধু বিশ্বাস করে। তার পায়ের তলার মাটিতে নেই সংশয়ের ফাটল। সে জানে এবং মানে যে ঘোষপাড়ার ডালিমতলার মাটি গায়ে মেখে হিমসাগরের জলে স্নান করে সতী মায়ের নাম ভক্তিভাবে নিলে সব রোগ সেরে যায়। ঘোষপাড়ার মেলার আগের দিন সেই ভরদুপুরে অগণিত ভক্ত মানুষদের মাঝখানে আসন পেতে বসে ডালিমতলার দিকে তাকাই। এই মাটিতে সব রোগ সারে? এত হাজার হাজার মানুষ সেই বিশ্বাসের জোরে এখানে এসেছে? রয়েল ফকির আমার সংশয়ী চোখে চোখ রেখে হেসে বলে, ‘বাবা বিশ্বাস করো, বিশ্বাসে মুক্তি।’ তারপরে তার দলের দীনুরতন দাসীকে বলে, ‘দীনু, সতী মায়ের মাহিত্ম্য তুমি বাবুরে একটু শোনাও দিনি। উনি শান্তি পাবেন।’
দীনুরতন দাসী ঊর্ধ্ব করে অলক্ষ সতী মাকে প্রণতি জানিয়ে পাঁচালীর সুর করে বলে।
সতী মা উপরে যেবা রাখিবে বিশ্বাস।
সেরে যাবে কুষ্ঠ ব্যাধি হাঁপ শূল কাশ॥
কৃপা হলে ভবে তাঁর ঘটে অঘটন।
অন্ধ পায় দৃষ্টিশক্তি বধিরে শ্রবণ॥
চিত্ত যেবা রাখে পায় বিত্ত পায় ভবে।
বন্ধ্যানারী পুত্র পাবে তাঁহার প্রভাবে॥
সতী মার ভোগ দিতে হবে যার মতি।
সকল বিপদে সেই পাবে অব্যাহতি ॥
কথাগুলো রয়েল ফকিরের দলের সকলেরই খুব মনোমত সে কথা বোঝা যায় তাদের মাথার দুলুনিতে। রয়েল ফকির বলেন: আমরা এইরকম শুনেচি যে আউলচাঁদ ফকির, রামশরণ আর সরস্বতীর সেবাধর্মে অনেকদিন ধরে খুব তুষ্ট হয়ে শেষে একদিন বললেন, ‘এবারে আমি চলে যাব।’ ‘না না’ সরস্বতী কেঁদে পড়লেন তাঁর পায়ে। অনেক কান্নাকাটির পরে শেষমেশ রফা হল আউলচাঁদ জন্মাবেন তাঁর গর্ভে সন্তান হয়ে। সেই সন্তানই হলেন আমাদের এই লালশশী। তিনিই নিরঞ্জন। গোকুলে যেমন যশোদার দুলাল কৃষ্ণ, অযোধ্যায় যেমন কৌশল্যার দুলাল রামচন্দ্র, নবদ্বীপে যেমন শচীমার দুলাল গোরাচাঁদ, আমাদের এই ঘোষপাড়ায় তেমনই সতী মায়ের দুলালচাঁদ। এই চারেই এক, একেই চার। বুঝলেন?
বুঝলাম, কর্তাভজা ধর্মে রয়েছে এক মেধাবী বিন্যাস, যার মূলে দুলালচাঁদের কল্পনাগৌরব আর বুদ্ধির কৌশল। একদিকে অবতারত্ত্ব আরেকদিকে রোগ আরোগ্যের উপাখ্যান। একদিকে সহজসাধন আরেকদিকে ভাবের গান। একদিকে আসন-গদি-অর্থাগম আরেকদিকে বিধবা ও পুত্রহীনাদের সান্ত্বনা। শিক্ষিত মানুষের কাছে যা সমন্বয়বাদের কারণে আকর্ষণীয়, অশিক্ষিতদের কাছে তা সতী মা-র মাতৃতান্ত্রিকতায় ভরপুর ও মোহময়। অবশ্য দুলালচাঁদের ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তিগত এলেমও কম ছিল না। জানালেন সত্যশিব পাল দেবমহান্ত অর্থাৎ দুলালের উত্তরপুরুষ অন্যতম কর্তা। সুবিনয়ী শিক্ষিত মানুষ সত্যশিব বাবু দুলালের প্রশস্তি করতে গিয়ে আমাকে চমকে দিয়ে জানালেন, ‘১৮৯৩ সালে শিকাগোর রিলিজিয়াস কংগ্রেসে রামদুলাল পাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। সে চিঠি আমার কাছে আজও আছে। চিঠির তারিখ ১৭ এপ্রিল ১৮৯৩। কিন্তু তার অনেক আগেই তো দুলালচাঁদ দেহ রেখেছেন। তাই তাঁর নাতি সত্যচরণ দেবমহান্তকে ওই পদ দেওয়া হয়।’