কর্তাভজাদের ভক্তি আর বিশ্বাসের তীব্রতা বিপ্লব এনেছিল সেকালের ব্রাহ্ম সেবাব্রতী শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে। তাঁর জীবনীকার কুলদাপ্রসাদ মল্লিক লিখেছেন:
শশিপদবাবুর সময়ে বরাহনগরে ‘কর্তাভজা’ নামক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেকগুলি উপাসনাস্থল ছিল। বনহুগলীতে নিমচাঁদ মৈত্রের বাগান এই সমস্তের মধ্যে অন্যতম। এইস্থানে সপ্তাহে একদিন করিয়া নিম্নজাতীয় হিন্দুগণ সম্মিলিত হইত এবং তাহাদের সাম্প্রদায়িক বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে স্তোত্রপাঠ ও আরাধনা করিত। শ্রীযুক্ত শশিপদবাবু সময়ে সময়ে এই স্থানে যাইতেন। তিনি স্বীকার করেন যে, তাহাদের উপাসনার ঐকান্তিকতার দ্বারা তিনি সেই দলে মিশিয়া বিশেষরূপে উপকৃত হইতেন।
কর্তাভজাদের সত্যধর্মযাজন এবং জাতিপঙ্ক্তিহীন উদার সমন্বয়বাদ সেকালে খুব সাধারণ মানুষদেরও কতখানি দ্বিধায় ফেলেছিল তার নমুনা মেলে ১২৫৪ বঙ্গাব্দে ১৮ চৈত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ছাপা জনৈক পত্রদাতার বক্তব্যে। ঘোষপাড়ার মেলা স্বচক্ষে দেখে তিনি লেখেন:
ঐ বহুসংখ্যক কর্ত্তামতাবলম্বিরা কেবল যে ইতর জাতি ও শাস্ত্রবিধিবর্জ্জিত মনুষ্য তাহা নহে তাহাদের মধ্যে সৎকুলোদ্ভব মান্য, বিদ্বান, এবং সূক্ষ্মদর্শিজন দৃষ্ট হইল।…
যেহেতু ব্রাহ্মণ, শূদ্র, যবন প্রভৃতি জাতি নীচেদের অন্নবিচার না করিয়া এরূপ ক্ষেত্রে ভোজন ও পান করে ইহা কুত্রাপি কোন স্থানে দেখি নাই ও শুনি নাই, বিশেষ আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে যদবধি আমরা উক্ত পল্লীতে উপস্থিত ছিলাম তদবধিক্ষণ মাত্র কাহাকেও অসুখি দেখি নাই, সকলেই হাস্যাস্যে সময়ক্ষেপ করিতেছিল, বোধহয় রাসের তিন দিবস তথায় আনন্দ বিরাজমান থাকে, সম্পাদক মহাশয়, ঘোষপাড়ার বিষয়ে নানা মহাশয়ের নানা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, কিন্তু আমরা অল্পবুদ্ধিজীবী মনুষ্য হঠাৎ কোন বিষয়ে কোন মত প্রকাশ করিতে সাহসিক হই নাই, ঘোষপাড়া ধৰ্ম্মের নিগূঢ় তথ্য যে পর্য্যন্ত আমরা না জানিতে পারি সে পর্য্যন্ত তদ্বিষয়ে আমরা কিছুই স্থির করিতে সক্ষম হইব না, যদিও এ ধৰ্ম্ম শাস্ত্রসম্মত নহে ও ইহার বাহ্যপ্রকরণ সমস্ত অনাচারযুক্ত, কিন্তু যখন বহুলোকের ঐ মতের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এবং ইদানীন্তন বিদ্যার স্রোত প্রবল হইয়া হ্রাস না হইয়া উন্নতি হইতেছে তখন ইহার অন্তরে কিছু সারত্ব থাকিবেক, এরূপ অনুমান করা নিতান্ত অসম্মত নহে।
নবীনচন্দ্র সেন যখন ১৮৯৫ সালে ঘোষপাড়ার মেলায় যান তখন সকালবেলা কয়েকজন ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁরা ‘সকলেই প্রায় গ্র্যাজুয়েট, সুশিক্ষিত ও পদস্থ। সকলেই কর্তাভজা’। এ সব বিবরণ পড়ে জানতে ইচ্ছে করে কতসংখ্যক মানুষ না জানি আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিলগ্নে কর্তাভজা ধর্মে যোগ দিয়েছিল যাতে নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণরা বার করেছিলেন জেলেপাড়ার সং তাদের গালমন্দ করে কিংবা নবদ্বীপের পণ্ডিতদের মদতে দাশু রায় লিখেছিলেন কর্তাভজা পাঁচালী। তার ব্যঙ্গ বড় নির্মম আর অশালীন। যেমন:
কর্তাভজা করতে যাই চলো সকলে।
বজায় করবি যদি দুকুলে
কেন যাস হয়ে ব্যাকুলে
হারিয়ে দুকূল কুল তেজে অনন্ত কুলে।
এতে করতেছে মজা কতজন
করিয়ে পূজা আয়োজন
যাবো নির্জন স্থানে প্রতি শুক্রবারে হ’লে।
বৃক্ষে উঠি হবেন মুরলীধর
আমরা করে ঢাকিব পয়োধর
হেসে আধা করিব অধর
তখন কত সুখ পাবে।
হবে ব্রজের লীলা শুন বলি।
কেউ বৃন্দে কেউ চন্দ্রাবলী
ললিতে আদি কেউ হবে শ্রীরাধা
লেগে যাবে ভারি চটক
কেউ কারে করিবে না আটক
কর্মে দিবে না কেউ বাধা।
এত যে প্রতিরোধ, এমন যে বিদ্রুপ তার মূলে শুধুই ভ্রষ্টাচার আর ধর্মীয় বিরোধ? আমার তো মনে হয়, কর্তাভজাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আর সংঘবদ্ধতা ভাবিয়ে তুলেছিল হিন্দু আর ব্রাহ্মদের। কিন্তু কত শিষ্য ছিল এঁদের? তাঁদের সংগঠিত করলেন কে?
নিঃসন্দেহে দুলালচাঁদ ওরফে লালশশী। উনিশ শতকীয় শিক্ষিত যুবা। বাংলা সংস্কৃত ইংরাজি পারসি চারটি ভাষাই ভালমতো জানতেন। ১৭৮৩ সালে যখন রামশরণের মৃত্যু ঘটে তখন দুলালচাঁদের বয়স মাত্র সাত। তাঁর মা সরস্বতী দেবী (পরে তিনি বিখ্যাত হন ‘সতী মা’ নামে) কিছুকাল কর্তাভজাদের নেতৃত্ব দেন। তারপরে দুলালের ষোলো বছর বয়স হতেই তাঁর হাতে নেতৃত্ব আসে। কিন্তু অপরিণত বয়সে দুলাল মারা যান ১৮৩৩ সালে। এই ক্ষণজীবী মানুষটি কর্তাভজাদের আচরণবিধি ও সংগঠন চিরকালের মতো সুদূঢ় করে গেছেন। রয়েল ফকিররা একশো বছর ধরে এঁর লেখা আইনপুস্তক ‘ভাবের গীত’ গায়, বুকে ভরসা জাগে। সে গানগুলি নাকি মুখে মুখে বলে যেতেন দুলাল আর লিখে নিতেন রামচরণ চট্টোপাধ্যায়। রামচরণ মূলে ছিলেন বেলুড়ের এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। তিনি ছাড়া দুলালের ঘনিষ্ঠ পার্ষদ ছিলেন বাঁকাচাঁদ, কাশীনাথ বসু, শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য, রামানন্দ মজুমদার আর নীলকণ্ঠ মজুমদার। ১৮৪৬ সালের ‘ক্যালকাটা রিভিয়্যু’-এর ষষ্ঠ খণ্ডে দুলাল সম্পর্কে একটি বর্ণনা রয়েছে। তাতে দেখা যায় ১৮০২ সালে মার্শম্যান আর কেরি দুলালের কাছে গিয়েছিলেন সর্বেশ্বরবাদ নিয়ে তর্ক করতে। তাতে দুলালের চেহারার বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘he was no less plump than Bacchus’। মানুষটি কি উনিশ শতকীয় রীতিমাফিক খুব ভোগীও ছিলেন? একজন লিখেছেন: